বৈষম্য ও শোষণের শিকল ছিঁড়ে বারবার গণমানুষকে মুক্তি দিয়েছে দেশের তরুণরাই - Alokitobarta
আজ : রবিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদঃ
বিপুর বিপুল লুটপাট,পাহারায় উপদেষ্টার স্বামী ! ২৩ লাখ মৃত ভোটার,নতুন ভোটার ৬৩ লাখ সংসদ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ছাত্র-জনতার গণহত্যায় জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা পুরস্কৃত হচ্ছেন বিতর্কিতরা, বিবেচনায় নেই স্বৈরাচারবিরোধী অগ্রণী ভূমিকা পালনকারীরা চুরি, ডাকাতি, অপহরণ,অবৈধ দখলদারির সহ বিভিন্ন মামলা থাকা সত্ত্বেও দেশকে অস্থিতিশীল করার মাষ্টার মাইন... কুয়েট ভিসি-প্রোভিসিকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি দেশে শক্তিশালী উদ্ভাবনী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সবাই কার্যকর অবদান রাখবেন বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষ ১০-এ নেই রাজধানী ঢাকা নির্বাচন ঘিরে ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

বৈষম্য ও শোষণের শিকল ছিঁড়ে বারবার গণমানুষকে মুক্তি দিয়েছে দেশের তরুণরাই


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া:বৈষম্য ও শোষণের শিকল ছিঁড়ে বারবার গণমানুষকে মুক্তি দিয়েছে দেশের তরুণরাই। এবারো এই তরুণরা রাজপথে ঢেলে দিল তাজাপ্রাণ। তাদেরই রক্তঋণে ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে দেশ। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে মরচে ধরা সিস্টেমকে ঘষেমেজে সংস্কারের মহাযজ্ঞ শুরু করেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ পার করছে এ মুহূর্তে।বাংলাদেশ নামের এই সবুজ সোনার দেশটি যতবারই বিপদে পড়েছে, ততবারই এ দেশের তরুণসমাজ দেশকে রক্ষায় দুই বাহু প্রসারিত করে বুক পেতে দিয়েছে। ৪৭, ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ কিংবা ২০২৪— ইতিহাসের পথপরিক্রমায় তরুণরাই পথ দেখিয়েছে এই সবুজ-শ্যামল দেশটিকে।

চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ও সেই সূত্র ধরে রাজনৈতিক পালা বদলে দেশের তরুণরা আবারো প্রমাণ করেছে, পরিবর্তনকে অবরুদ্ধ করে রাখা শুধু মুশকিলই নয়, অসম্ভবও বটে! মূলত সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা এবং কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। রক্তক্ষয়ী দুর্বার আন্দোলনে তরুণদের অন্যতম ও প্রধানতম দাবি হয়ে উঠে সমাজের প্রতিটি স্তরে জেঁকে বসা বৈষম্যের দেয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া। এখন সরকার সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে। নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করে দেওয়া হয়েছে।

সরকারের এমন উদ্যোগের মধ্যে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছেন। খুব দ্রুতই তারা জাতীয় নির্বাচন চাচ্ছেন। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, জুলাইয়ের সহস্র শহীদের প্রাণদান যেন শুধু একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতেই হয়েছে! বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। শুধু একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য এই অভ্যূত্থান হয়নি। ছাত্রদের মুখর স্লোগানে কখনোই নির্বাচনের দাবি করা হয়নি। শহর কিংবা মফস্বলের অলিতে গলিতে আঁকানো দেয়াল চিত্রের কোথাও নির্বাচনের জন্যই যে এই আন্দোলন, তা বলা হয়নি। মূলত, দেশের প্রতিটি স্তরে যে ব্যাড সিস্টেমগুলো সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো দূর করে নতুন এক রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণের জন্যই ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছে।

৫৪ বছর আগে আমাদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ ছিল সীমাহীন। যে কারণে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এ দেশের তরুণরা। পরে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে জন্ম নেয় সম্ভাবনার বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছরেও দেশের মানুষ মুক্তি পায়নি। সেই মুক্তির জন্য বারবার এ দেশের তরুণরা রক্ত দিয়েছে। চব্বিশেও আজকের তরুণরা প্রাণ দিয়েছে। তারা আবারো গণমানুষের সেই মুক্তির জন্য লড়াই করছে। এই মুক্তি তখনই মিলবে যখন রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘূণে ধরা ব্যবস্থাকে সংস্কার তথা মেরামত করে ঢেলে সাজানো যাবে। ড. ইউনূসের সরকার সেই রাষ্ট্র মেরামতের কাজটিই করছে।

তবে আশার কথা হলো, দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল প্রধান প্রধান খাতগুলোতে সংস্কারের জন্য সরকারকে সময় দেওয়ার জন্য রাজি। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে সংস্কারের আগে তারা কোনোভাবেই ভোট আয়োজন করতে চায় না। কারণ নির্বাচনের মাঠে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের বিরাট ভূমিকা থাকে। কিন্তু বর্তমান পুলিশ বাহিনীর সিংহভাগ সদস্যই গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া। গোটা পুলিশ বাহিনীকে শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে দলীয় লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে, সেরকম নজির আর এ দেশের ইতিহাসে নেই। ফলে এই বাহিনীর যথাযথ সংস্কার ছাড়া নির্বাচন আয়োজন করলে দেশে গৃহযুদ্ধের মতো কারবালা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত এসপিদের বিরুদ্ধে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে, ফ্যাসিবাদ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী সেই এসপিদের অনেকেই এখনো বহাল তবিয়তে আছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে।বিতর্কিত এসব নির্বাচনে জেলার এসপিদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হন।পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেই রয়েছে বিতর্ক।২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও আগের রাতেই ব্যালট পেপার দিয়ে ভরে রাখা হয় ভোটের বক্স। ২০২৪ সালেও একতরফা নির্বাচন হয়। তিন নির্বাচনেই জয় লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত এসপিদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত ২৪ জানুয়ারি।

বিসিএস পুলিশের ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা রেজাউল হক। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের সময় তিনি ছিলেন রাজবাড়ীর এসপি। ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত ছিলেন রাজবাড়ী জেলার দায়িত্বে। এরপর তিনি ফেনী জেলায় যোগ দেন এসপি হিসাবে। আড়াই বছর সেখানে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এআইজি হিসাবে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দেন। গত জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভোল পালটে ফেলেন তিনি। সেপ্টেম্বরে যোগ দেন খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি হিসাবে। বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিলেও তিনি এখনো আছেন বহাল তবিয়তে।

২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে মজিদ আলী ছিলেন ঝালকাঠির এসপি। পরে দায়িত্ব পান খাগড়াছড়ির। ফ্যাসিবাদ সরকারের আমলে সুবিধাবাদী এই কর্মকর্তা ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। তিনি এখন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরপিএমপি) কমিশনার। তিনি বলেন, চাকরি আছে আর অল্পদিন। যদি জনগণ অনুগ্রহ করে তবে চাকরি করব, না হলে বাড়ি ফিরে যাব।

২০১৪ সালে গোপালগঞ্জের এসপি হিসাবে দায়িত্ব পালন করা মিজানুর রহমান এখন নৌপুলিশের ডিআইজি। মাঝে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসপি হিসাবে। এখানে থাকা অবস্থায় অতিরিক্তি ডিআইজি হিসাবে পদোন্নতি পান। মিজানুর রহমান বলেন, বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করলেও আমি স্বৈরাচারের সহযোগী নই। বাস্তবতা ভিন্ন। সে বিষয়ে বলতে চাই না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি কখনো হারাম খাইনি।

২০১৪ সালের নির্বাচনকালীন দিনাজপুরের এসপি ছিলেন রুহুল আমিন। তিনি এখন ডিআইজি। দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশের ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট বিভাগের। রুহুল আমিন বলেন. আমি যখন জেলার এসপি ছিলাম, তখন রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে এত ঘাঁটাঘাাঁটি হতো না। যখন রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ঘাঁটাঘাাঁটি শুরু হলো তখন প্রমোশন আটকে গেল। পরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ডিআইজি হলাম।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় পঞ্চগড়ের এসপি ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। এখন তিনি হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি। নিজের বর্তমান অবস্থান সঠিক জানিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় কোনো জেলার দায়িত্বে ছিলাম না। পঞ্চগড়ের এসপি ছিলাম ২০১২ সালে। অথচ আনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনি ২০১৩ সালের মার্চ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পঞ্চগড়ের এসপি ছিলেন। সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের নিকটাত্মীয় তিনি। ওই সময় তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।

২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় একেএম এহসান উল্লাহ ছিলেন বরিশালের এসপি। তিনি বলেন, আমি বর্তমানে পুলিশ একাডেমি সারদায় আছি। স্বাভাবিক বদলি প্রক্রিয়ায় আমাকে ২০২২ সালে ডিআইজি হিসাবে পুলিশ একাডেমিতে বদলি করা হয়। এর পর থকে এখানেই আছি। এর আগে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে নৌপুলিশে কর্মরত ছিলাম। মাঝে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স (এনডিসি) সম্পন্ন করি।

২০১৪ সালে মাদারীপুরের এসপি হিসাবে দায়িত্ব পালন করা খো. ফরিদুল ইসলাম এখন ডিএমপির যুগ্মকমিশনার। ফরিদুল ইসলাম বলেন, ২০১৪ সালে মাদারীপুরের এসপি থাকলেও সেটা রাজনৈতিক বিবেচনায় ছিল না। তৎকালীন আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার চাচ্ছিলেন সেখানে একজন সৎ এসপি নিয়োগ দিতে। তার ওই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে আমাকে এসপি হিসাবে পদায়ন দেওয়ায়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঠাকুরগাঁওয়ের এসপি হিসাবে দায়িত্বপালনকারী ফয়সাল মাহমুদ এখন বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদায় কর্মরত। বর্তমানে তার পদমর্যাদা অতিরিক্ত ডিআইজি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই দফায় পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার পর ২০২২ সালে পদোন্নতি পাই। নরমাল পোস্টিং হিসাবেই সারদায় আছি। মাঝে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনে এবং রাজশাহী রেঞ্জে দায়িত্ব পালন করেছি।

২০১৪ সালে বিধান ত্রিপুরা ছিলেন মানিকগঞ্জের এসপি। এখন তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি। বিধান ত্রিপুরা বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন হয়েছে বিরোধী দলবিহীন। ২০১৮ সালের মতো দিনের ভোট রাতে হয়নি। বিরোধী দল না থাকায় ওই নির্বাচনে ভোটারও ছিল না। বিকাল ৩টা থেকে চারটার মধ্যেই নির্বাচন শেষ হয়েছে। সেখানে এসপির তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। রিটার্নিং অফিসার এবং পোলিং অফিসাররাই সব করেছেন। আমি দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় কোনো অপরাধ করিনি। আমি এসপি হিসাবে জেলায় যোগদান করতেই চাইনি। আমাকে জোর করে পাঠানো হয়েছিল।

২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়ার এসপি ছিলেন বিসিএস ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। এর আগে ছিলেন চুয়াডাঙ্গার এসপি। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত মফিজ উদ্দিন এখন ডিআইজি হিসাবে কাজ করছেন অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটে (এটিইউ)। ২০১৬ সালের অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান। পরে দায়িত্ব পালন করেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি হিসাবে। দুই বছর ধরে তিনি কাজ করছেন এটিইউতে।

আরও যেসব কর্মকর্তা পুনর্বাসিত : তোফায়েল আহাম্মদ ২০১৪ সালে ছিলেন মৌলভীবাজারের এসপি। এখন তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত আছেন অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে। সৈয়দ মোসফিকুর রহমান ২০১৪ সালে ছিলেন পটুয়াখালীর এসপি। এখন অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটে (এটিইউ) অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন রংপুর এলাকার। পিরোজপুরের এসপি হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী এসএম আক্তারুজ্জামান এখন পুলিশ স্টাফ কলেজের ডিআইজি। ফেনীর তৎকালীন এসপি পরিতোষ ঘোষ এপিবিএনে দায়িত্ব পালন করছেন ডিআইজি হিসাবে। খুলনার ওই সময়ের এসপি গোলাম রউফ খান এখন রেলওয়ে পুলিশের ডিআইজি। নওগাঁর তৎকালীন এসপি কাইয়ুমুজ্জমান এখন অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে কর্মরত নৌপুলিশে। সুনামগঞ্জের ওই সময়ের এসপি হারুন অর রশীদ এখন একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক (নিরাপত্তা) হিসাবে কর্মরত। রংপুরে এসপি হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী আব্দুর রাজ্জাক অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে এপিবিএনে কর্মরত। লালমনিরহাটের তৎকালীন এসপি হাবিবুর রহমান সিআইডিতে কর্মরত ডিআইজি হিসাবে। টাঙ্গাইলের ওই সময়ের এসপি সালেহ মোহাম্মদ তানভীর এখন পুলিশ সদর দপ্তরে ডিআইজি হিসাবে কর্মরত।

২০২৪ সালে বিভিন্ন জেলায় এসপি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত শাস্তির মুখোমুখি বা সংযুক্ত না হয়ে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করছেন তাদের সংখ্যা অন্তত ৩৫ জন। বাকি কারও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমন ৩৫ জনের মধ্যে আছেন-মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম, মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন, মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, মনজুর রহমান, ছাইদুল ইসলাম, মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম, এসএম সিরাজুল হুদা, রাফিউল আলম, মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, মাহফুজুল ইসলাম, মোহাম্মদ শফিউর রহমান, জিএম আবুল কালাম আজাদ, আকরামুল হোসেন, মোহা. মেহেদী হাসান, আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম, এসএম নাজমুল হক, মুহাম্মদ রাশিদুল হক, মোহাম্মদ নূরে আলম, মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, মো. মাহিদুজ্জামান, মোহাম্মদ আফরুজুল হক টুটুল, মুক্তা ধর, উত্তম প্রসাদ পাঠক, মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, এমএন মোর্শেদ, মুহাম্মদ মতিউর রহমান সিদ্দিকী, আরএম ফয়জুর রহমান, মাহবুবুল আলম, সৈকত শাহীন, মীর আবু তৌহিদ. মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ, মোকবুল হোসেন, ফয়েজ আহমেদ প্রমুখ।

পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ একটি ভার্চ্যুয়াল মিটিংয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, যেখানে তিনি দাবি করেছেন, পুলিশের ও প্রশাসনের ৯০ ভাগই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। তার এই বক্তব্যে তিনি জানান, সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা চলছে এবং তাড়াতাড়ি নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য পরিকল্পনা হচ্ছে।

বেনজীর আহমেদ বলেন, “তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্ল্যান করা হচ্ছে। আপাতত ডক্টর ইউনূসের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না, তবে সরকারের অসহযোগিতা করা এবং ব্যর্থ করে তাড়াতাড়ি নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনা হবে। এরপর বিএনপির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বিএনপিকে হটানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ”

পুলিশ কর্তা বেনজীরের এই দম্ভমূলক উক্তিই প্রমাণ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে পুলিশের সংস্কার কতোটা জরুরি। পুলিশের সংস্কার ছাড়া যেকোনো নির্বাচন আয়োজনই ঝুঁকির সৃষ্টি করবে।

দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ অবধি আমাদের দেশে পুলিশ কখনোই জনগণের বন্ধু হবার চেষ্টা করেনি। বিশেষ করে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে পুলিশ সরকারি দলের লাঠিয়ালের ভূমিকায় হাজির হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ, গুম হয়েছেন বহু। এ কারণে সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ও অনাস্থাও চরম আকার ধারণ করে। পুলিশের এমন আচরণ নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো। পুলিশ প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে জনগণের সঙ্গে সৌহার্দ্য প্রদর্শনের চাইতে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকেই জরুরি মনে করতো, যে কারণে বাহিনীটি ক্রমেই অকার্যকর হতে থাকে এবং সমাজে বিভাজনের পরিবেশ তরান্বিত হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের অভিযোগে ক্রমেই পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা নিম্নমুখী। সেবা ও সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশকে হরহামেশাই মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিকে উহ্য রেখে একটি সংকীর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে দেখা যায়।

এমন বাস্তবতায় স্পর্শকাতর একটি পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভোট আয়োজন শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। এ কারণে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ঝুঁকি এড়াতে আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করা উচিৎ। পাশাপাশি রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চালিয়ে যাওয়া। যেমনটা জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত মার্চ মাসের এক সভায় কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মত প্রকাশ করেন যে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়া বেশি যৌক্তিক। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকাজ শেষ করা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার কাজটিও করতে হবে।

‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনবিষয়ক সংলাপ’ শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেছেন, দুটি সংস্কার কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত জনমত জরিপেও দেখা গেছে, প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ আগে স্থানীয় নির্বাচন চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মূহুর্তে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনপ্রতিনিধি না থাকায় মানুষ সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে শিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য এগিয়ে আসবেন। দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হলে প্রার্থী কেনা-বেচা হয়, এর বাইরে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা নিজের ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। তাঁদের বিজয়ী করতে দলীয় ও প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যও আগে স্থানীয় নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সহজ হয়। আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা যাচাই করারও সুযোগ হবে। শুধু এবার নয়, সব সময় নির্দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা এখন সময়ের দাবি।

নির্বাচনে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখনো পুলিশ নিষ্ক্রিয়। প্রশাসনেও সমস্যা আছে। প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করবে, তা আশা করা যায় না।

নিরাপদ সড়ক চাই–এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনও বলেছেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে অনেক উপকার হবে। তবে সবার আগে রাজনীতিবিদদের মধ্যে পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, রাজনীতিবিদদের মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?

অনেক বিশ্লেষক আবার বলছেন পুলিশ বাহিনী ও আইনের সংস্কারের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল জরুরি। প্রতিটি সংকট একইসঙ্গে কোনো না কোনো সুযোগও আনে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পদক্ষেপ, তবে এখানেই থামলে চলবে না। দীর্ঘস্থায়ী, রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের জন্য সামনে আরো পথ পাড়ি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে পুলিশিং এ এমন পরিবর্তন তরান্বিত করতে হবে, যাতে করে বাহিনীর সংস্কৃতি, আচরণ, কাঠামো এবং আইনেও বদল আসে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন প্রেস ক্লাব-এ সভাপতি।
বাংলাদেশ অনলাইন সংবাদপত্র ও সাংবাদিক ইউনিয়ন-এ এ কেন্দ্রীয় সভাপতি।
বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স ইউনিটি-এ যুগ্ন মহাসচিব কেন্দ্রীয় কমিটি ঢাকা।
বাংলাদেশ সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ঐক্য পরিষদ-এ এর কেন্দ্রীয় কমিটি-এ সাধারন সম্পাদক।
দক্ষিণবঙ্গ প্রেসক্লাব-এ সভাপতি।
আলোকিত বার্তা -এ প্রকাশক ও সম্পাদক
প্রিয় টাইম-এ সম্পাদক

Top