তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিবসকে পরস্পরের অনুগামীরূপে - Alokitobarta
আজ : রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিবসকে পরস্পরের অনুগামীরূপে


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসাবে একটি বর্ষ শেষ হয়ে আরেকটি বর্ষ শুরু হবে। কাল থেকে তারিখ লিখতে বছরের ঘরে লেখা হবে ২০২৪। চলতি তারিখ লিখতে গিয়ে আর কখনোই লেখা হবে না ২০২৩। সুতরাং বিদায় বন্ধু ‘দুই হাজার তেইশ’!এই বন্ধুটি আমাদের জীবনে একবারই মাত্র এসেছিল। আর এই যে বিদায় নিলো আর কখনোই সে ফিরে আসবে না। ক্যালেন্ডারে সংখ্যার এই যে আসা-যাওয়া প্রকৃতপক্ষে এ তো আমাদেরই জীবনের কাব্য। যে এসেছে, শুধু একবারের জন্যই এসেছে। আর যে বিদায় নিয়েছে, চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে!ক্যালেন্ডার থেকে একটি সংখ্যার বিদায় আসলে কি সংখ্যার বিদায়? না, সংখ্যার বিদায় নয়, আমাদের জীবনকালের একটি অংশের বিদায়। আর এ কারণেই যে কোনো ক্যালেন্ডারে বর্ষশুরু ও বর্ষশেষ উৎসবের ব্যাপার নয়, চিন্তা-ভাবনা ও হিসাব-নিকাশের ব্যাপার।

কিসের হিসাব-নিকাশ? বিনিয়োগ ও লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ। জীবনকাল মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ পুঁজি। আর তার বিনিয়োগক্ষেত্র হচ্ছে তার নিজের কর্ম। জীবনকাল ভালো কাজে ব্যয় হলে তা ফেরত আসবে মুনাফাসহ। আর মন্দ কাজে ব্যয় হলে তা বয়ে আনবে পরিতাপ ও ক্ষতিগ্রস্ততা। যে কণা পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে। আর যে কণা পরিমাণ মন্দ কাজ করবে সে-ও তা দেখতে পাবে। (সূরা

যিলযাল : ৭-৮)।দিন-রাতের গমনাগমন আসলে সতর্ক করছে খরচ হয়ে যাওয়া জীবনকাল সম্পর্কে। প্রতিটি সন্ধ্যা এই বার্তা দিচ্ছে যে, তোমার জীবন থেকে একটি দিবস ফুরিয়ে গেল। প্রতিটি ভোর এই বার্তা দিচ্ছে যে, আরো একটি রাত জীবন থেকে বিদায় নিল। কাজেই ব্যয় হয়ে যাওয়া দিবস ও রজনী যদি ভালো কাজে ব্যয় হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহর শোকরগোযারি, যদি মন্দ কাজে ব্যয় হয়ে থাকে তাহলে ভবিষ্যতের জন্য সংশোধনের সংকল্প- এই তো উপায় মুক্তির ও উন্নতির।

আর এতে কালক্ষেপণ নয়। কারণ এরপর আর প্রত্যাবর্তনের সুযোগ না-ও হতে পারে। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেছেন : সন্ধ্যায় উপনীত হলে প্রভাতের অপেক্ষা করো না। আর প্রভাতে করো না সন্ধ্যার অপেক্ষা।… কারণ, হে আল্লাহর বান্দা! তোমার তো জানা নেই কী হবে তোমার বিশেষণ আগামীকাল (জীবিত না মৃত!) (জামে তিরমিযী : ২৩৩৩)। কুরআন মাজীদে দিন-রাতের গমনাগমন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিবসকে পরস্পরের অনুগামীরূপে; তার জন্য যে উপদেশ গ্রহণ করে ও কৃতজ্ঞ হতে চায়। (সূরা ফুরকান : ৬২)।রাত-দিনের আসা-যাওয়া একটি ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য ব্যাপার, যা সময়ের চলমানতা সম্পর্কে সচকিত করে। চিন্তাশীল মানুষ উপলব্ধি করেন যে, দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছরের রূপে বস্তুত তার নিজের আয়ুই নিঃশেষ হয়ে চলেছে। কাজেই আর অবহেলা নয়, এবার ব্রতী হতে হবে সৎকর্মে এবং ত্যাগ করতে হবে সকল বালখিল্যতা। পরিণত বয়সীর অপরিণত কর্ম সম্পর্কে এক জ্ঞানীর আক্ষেপ : তোমার প্রিয় জীবনকালের চল্লিশটি বছর কেটে গেছে। কিন্তু তোমার স্বভাব-বাল্য এখনো কাটল না!

বাল্য ও অপরিপক্কতা কী? কর্মের পরিণাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উদাসিনতাই নয় কি? আর তাই হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে : বুদ্ধিমান তো সে, যে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কর্ম করে। আর অক্ষম সে, যে প্রবৃত্তির অনুসারী হয় আর আল্লাহর প্রতি (অলীক) প্রত্যাশা পোষণ করে। (জামে তিরমিযী : ২৪৫৯)।প্রতিটি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত আমাদের জানাচ্ছে জীবনের ক্ষয় সম্পর্কে। কিন্তু আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষের জীবনে বর্ষশেষ ক্ষয়ের বার্তা নিয়ে আসে না, আসে অবক্ষয়ের অনুষঙ্গ হয়ে। এই অসঙ্গতি ও অস্বাভাবিকতা এখন সঙ্গত ও স্বাভাবিক। বহুল চর্চা ও ব্যাপক রেওয়াজের কারণে এগুলো অস্বাভাবিক বলেই মনে হয় না।

বস্তুত, বক্রতার যখন বিস্তার ঘটে তখন বাঁকাকে আর বাঁকা বলে মনে হয় না। কিন্তু মনে না হলেই কি বক্রতা দূর হয়? আমাদের চারপাশে এখন কত বক্রতার ছড়াছড়ি! চিন্তার বক্রতা, কর্মের বক্রতা, রীতি-নীতির বক্রতা! সেই বক্রতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করলে প্রতিদিনের নামাযে : (আমাদের পরিচালিত করুন সরল পথে)- এই প্রার্থনার যথার্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।সকল বক্রতা ও অস্বাভাবিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক চিন্তা, যথার্থ কর্ম ও ভারসাম্যপূর্ণ স্বভাবের অধিকারী হওয়া একজন মানুষের প্রতিমুহূর্তের প্রয়োজন। এই যথার্থতা ও ভারসাম্য তথা সীরাতে মুসতাকীমের দিশাই রয়েছে কুরআন মাজীদে এবং সুন্নাহ ও সীরাতে। তাই কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী খুব সহজেই মুক্ত থাকে চিন্তা ও কর্মের বক্রতা থেকে।থার্টিফাস্ট নাইটের বিগত দিনের অনাচার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এই মহা নি’আমত এবং সচেতন করে আদর্শহীন মানুষের অবলম্বনহীনতা সম্পর্কে। আমরা মহান আল্লাহর শোকরগোযারি করি আর ‘থার্টিফাস্ট’গ্রস্ত বন্ধুদের চিন্তা ও কর্মের স্বাভাবিকতার জন্যও তাঁরই সকাশে প্রার্থনা করি।

Top
%d bloggers like this: