ইসলামে সব ধরনের সুদই হারাম,সুদের ভয়াবহতা - Alokitobarta
আজ : শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসলামে সব ধরনের সুদই হারাম,সুদের ভয়াবহতা


মোহাম্মাদ নাসির উদ্দীন : আরবি ভাষায় সুদের প্রতিশব্দ রিবা। বাংলাভাষায় ‘সুদ’ শব্দটি যেমন সুপরিচিত, তেমনি আরবি ভাষায়ও ‘রিবা’ শব্দের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। যে ঋণ ঋণদাতার জন্য কোনো ধরনের মুনাফা বয়ে আনে সেটিই রিবা বা সুদ। ইসলামে সব ধরনের সুদই হারাম। ইন্টারেস্ট, ফিন্যান্সিয়াল চার্জ অথবা সুদ- যে নামেই তাকে ডাকা হোক, চাই তা মহাজনী সুদ হোক বা বাণিজ্যিক সুদ, চাই তা সরল সুদ হোক বা চক্রবৃদ্ধি সুদ কিংবা ব্যাংকিং সুদ হোক। কম হোক বা বেশি হোক।আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৭৫)পবিত্র কুরআনে বহু ধরনের গুনাহের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। সে সবের জন্য কঠোর শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে যত কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে অন্য কোনো গুনাহর ব্যাপারে এমনটি করা হয়নি।

ইসলাম রিবার নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে কেবল নৈতিক বিবেচনার অধীনে রাখেনি; বরং তাকে পুরোপুরি আইনের মর্যাদা দিয়েছে। এ বিষয়ে বিদায় হজে নবী সা:-এর ঐতিহাসিক ভাষণের সংশ্লিষ্ট অংশটুকু বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। নবীজী বলেছেন, ‘সাবধান! জাহেলিয়াতের প্রত্যেক বিষয় আমার দু’পায়ের নিচে।… জাহেলি যুগের ‘রিবা’ বাতিল। আর প্রথম রিবা, যা আমরা বাতিল করছি তা আমাদের রিবা; আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের রিবা। তা পুরোটাই বাতিল।’ (মুসলিম-১২১৮)

সুদখোর কিয়ামতের দিন যে অবস্থায় উঠবে : ‘যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতের দিন) সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটি এ জন্য যে, তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই। আর তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় করবে তারাই জাহান্নামের অধিবাসী হবে। সেখানে তারা হবে চিরস্থায়ী।’ (সূরা বাকারা-২ : ২৭৫)

সুদের অর্থে কোনো বরকত নেই : সুদের মাধ্যমে যত অর্থই উপার্জন করুক, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাতে কোনো বরকত নেই। ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না।’ (সূরা বাকারা-২ : ২৭৬)

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সুদ থেকে অর্জিত অর্থ বা তার বরকত নষ্ট করে দেন। আর সদকা দানকারীর অর্থ-সম্পদ বা তার বরকত বৃদ্ধি করে দেন।
সূরা রুমের ৩৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘যে সুদ তোমরা দিয়ে থাকো- যেন মানুষের সম্পদের সাথে মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহর কাছে তা বাড়ে না।’
সুদখোর ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত : ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও।’ যদি তোমরা না ছাড়ো তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। আর যদি তোমরা তাওবা করো, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। এতে তোমরা (কারো প্রতি) জুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতিও জুলুম করা হবে না।’ (সূরা বাকারা-২ : ২৭৮-২৭৯)

চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে স্বতন্ত্রভাবে নিষেধের কারণ : ‘হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সূরা আলে-ইমরান-৩ : ১৩০) এ আয়াতে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় আরবে চক্রবৃদ্ধি আকারে সুদ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। তা দূর করার জন্য এ আয়াতে চক্রবৃদ্ধি আকারে সুদ খেতে নিষেধ করা হয়েছে। তার মানে এ নয় যে, চক্রবৃদ্ধি আকারে না হলে সুদ খাওয়া হালাল হয়ে যাবে। কারণ, অন্যান্য আয়াতে যেকোনো রকমের সুদ খাওয়াকে হারাম করা হয়েছে।

‘ভালো ভালো যা ইহুদিদের জন্য বৈধ ছিল আমি তা তাদের জন্য অবৈধ করেছি; তাদের সীমালঙ্ঘনের জন্য, আল্লাহর পথে অনেককে বাধা দেয়ার জন্য এবং তাদের সুদ গ্রহণের জন্য, যদিও তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং অন্যায়ভাবে লোকদের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য। তাদের মধ্যে যারা কাফের তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি।’ (সূরা নিসা-৪ : ১৬০-১৬১)

ওই দুই আয়াতে ইহুদিদের যেসব অপরাধের কারণে তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তন্মধ্যে একটি ছিল তাদের সুদ গ্রহণের অপরাধ। এটি তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল, তবু তারা সুদ গ্রহণ করত। তাই তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের কঠিন শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

এরপর সুদের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে রাসূলে কারিম সা:-এর হাদিসগুলো :
সুদ সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজের একটি : নবী কারিম সা: বলেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকো।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেই সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ কী? তিনি বললেন, ১. আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করা; ২. জাদু করা; ৩. অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন; ৪. সুদ খাওয়া; ৫. এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা; ৬. জিহাদের ময়দান থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে যাওয়া; ৭. সতী-সাধ্বী সরলমনা-উদাসীনা মুমিন নারীদের বিরুদ্ধে অপকর্মের মিথ্যা অপবাদ দেয়া।’ (বুখারি : ২৭৬৬, ৬৮৫৭, মুসলিম-৮৯, সুনানে আবু দাউদ- ২৮৭৪, সুনানে নাসায়ি-৩৬৭১) সুদ সংশ্লিষ্ট সবাই অভিশপ্ত : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে- যে ব্যক্তি সুদ খায় এবং যে সুদ খাওয়ায় উভয়কে রাসূলে কারিম সা: লানত করেছেন। (মুসলিম-১৫৯৭, জামে তিরমিজি-১২০৬, সুনানে নাসায়ি-৫১০৪)

হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে সাতটি গুনাহকে বড় গুনাহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার অন্যতম হলো সুদ খাওয়া। (মুসনাদে বাযযার, আল মুজামুল কাবির, তবারানি-১০২, আলমুজামুল আওসাত, তবারানি-৫৭০৯)
অপর একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, যে সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয় সবার প্রতি রাসূলে কারিম সা: লানত করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ-৬৬০, সুনানে আবু দাউদ-৩৩৩৩, জামে তিরমিজি-১২০৬)

সুদখোর ব্যভিচারকারীর সমতুল্য : ব্যভিচার সবার কাছে নিন্দনীয়। বিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচার বেশি নিন্দনীয়। প্রতিবেশীর সাথে ব্যভিচার আরো বেশি জঘন্য। আর স্বীয় মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া কী পরিমাণ জঘন্য হতে পারে? সুদখোর সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে তার মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমান অপরাধে জড়িত। বর্ণিত আছে, ‘সুদ সত্তর প্রকার পাপের সমষ্টি। তার মাঝে সবচেয়ে নিম্নতম হলো আপন মায়ের সাথে ব্যভিচার করার সমতুল্য।’ (মুসনাদে আহমাদ-১৫৩৪৫)
‘সুদ থেকে অর্জিত এক দিরহাম পরিমাণ অর্থ (প্রায় ৩০০ টাকা) ইসলামের দৃষ্টিতে ৩৬ বার ব্যভিচার করা অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ।’ (মুসনাদে আহমাদ-২১৯৫৭)

সুদখোরের বরজখি জীবনের শাস্তি : সুদখোরকে মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত বরজখি জীবনে কঠিন আজাব দেয়া হবে। হজরত সামুরা ইবনে জুনদুব রা: থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে নবী কারিম সা:-এর একটি স্বপ্নের কথা বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- ‘আমি দেখলাম আজ রাতে আমার কাছে দু’জন মানুষ আসল এবং তারা আমাকে একটি পবিত্র ভূখণ্ডে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে একটি রক্তের নদীর কিনারে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেই নদীতে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। আর নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন পুরুষ। তার সামনে রয়েছে পাথর। যখন নদীর লোকটি কিনারে উঠতে চায় তখন কিনারে থাকা লোকটি তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করে। পাথরের আঘাতে লোকটি যেখানে ছিল সেখানে ফিরে যায়। এরপর সে আবারো নদীর কিনারে উঠতে চায়, এভাবে সে যখনই কিনারে উঠতে চায় তখনই তাকে পাথর মেরে যেখানে ছিল সেখানে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

আমি আমার সাথে থাকা লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, রক্তের নদীতে অবস্থিত লোকটি, যার মুখের ওপর পাথর মেরে আপন জায়গায় ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে, সে লোকটি কে? তখন তাদের একজন আমাকে বললেন, এ লোকটি সুদখোর।’ বুখারি : ১৩৮৬, ২০৮৫)
সুদখোরের পেট সাপে পরিপূর্ণ : রাসূল সা: বলেছেন, মেরাজের রাতে আমি এমন কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদের পেটগুলো বিশাল ঘরের মতো সামনের দিকে বের হয়ে আছে। তা ছিল অসংখ্য সাপে পরিপূর্ণ। যেগুলো পেটের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল, এরা কারা? তিনি জবাবে বলেন, এরা সুদখোরের দল। (মুসনাদে আহমাদ-৮৬৪০)

Top
%d bloggers like this: