‘হুনছি মোর আব্বায় সিডরের বইন্যায় মারা গেছে।মুই তহন আফুর দেই।মোর আব্বারে খুয়াইছি এহন মোরা মরতে চাইনা।
আলোকিত বার্তা:‘হুনছি মোর আব্বায় সিডরের বইন্যায় মারা গেছে।মুই তহন আফুর দেই।মোর আব্বারে খুয়াইছি এহন মোরা মরতে চাইনা। জন্মের পর হইতেই দেই ওয়াপদা (বেড়িবাঁধ) ভাঙ্গে আর ভাঙ্গে।’ কথাগুলো বলছিলো ১২ বছরের শিশু মো. ওয়াজকুরুনি। ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে শিশু ওয়াজকুরুনি বাবা আ. করিমকে হারিয়েছে। কয়েক বছরের মাথায় মা মনিরা বেগমও বিয়ে করেছেন। বাবার আদর স্নেহ পায়নি, মা থেকেও কাছে নেই। পদ্মা গ্রামের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বসতভিটা থাকায় ওয়াজকুরুনিও শঙ্কায় রয়েছে। সেই শঙ্কা থেকেই সিডরে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ দেখিয়ে বলে, ‘হুনছি এ গ্রামের অনেক মানুষ মারা গেছে, মোর আব্বায়ও মারা গেছে, এহন মোরা আর মরতে চাইনা। শক্ত বেড়িবাঁধ চাই।’
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটায় অনেক প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। বলেশ্বর, বিষখালী আর বঙ্গোপসাগরের মোহনা পদ্মা গ্রামটি। এ গ্রামের পাশেই বেড়িবাঁধ ভেঙে ভেতরে ও বাইরে থাকা অন্তত ৫২ জনের প্রাণহানি হয়। সিডরের পর থেকে বেশ কয়েকবার বেড়িবাঁধ মেরামত করা হলেও তার স্থায়ীত্ব বেশি দিন থাকেনা। বরগুনায় বেড়িবাঁধের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণীসহ একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে বাঁধ এখনও সম্পূর্ণ মেরামত হয়নি। এজন্য বিলীন হয়ে গেছে বহু বসতবাড়ি, গাছপালা এবং কয়েকশ’ একর ফসলি জমি। এসব বাঁধ সম্পূর্ণ মেরামত না হতেই ঘূর্ণিঝড় বুলবুলেও আতঙ্কে ছিলেন বাঁধ এলাকার লক্ষাধিক বাসিন্দা।
স্থানীয়দের দাবি, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে এ জেলার বহু মানুষ। রয়েছে জীবনহানির শঙ্কাও। তাদের অভিযোগ, যথাসময় পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এলাকাবাসী। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বরগুনা জেলায় ২২টি পোল্ডারে প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। এরমধ্যে বর্তমানে ৩৭ কিলোমিটার বাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি বাঁধও মেরামত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সিডরের ১২ বছর পেরুলো। পাথরঘাটার পদ্মা গ্রামের পদ্মা ভাঙন কবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এখনো সিডরের ক্ষতচিহ্ন। মানুষের বসবাসের পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ। কথা হয় বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বাসিন্দা আলমগীর হোসেন কালু মাঝির সঙ্গে। তিনিবলেন, এখানে অনেক মানুষ মারা গেছে। ভাগ্যক্রমে আমরা সাইক্লোন শেল্টারে থাকায় কোনো প্রাণহানি হয়নি। সিডরের পরে এই বেড়িবাঁধ অনেকবার মেরামত করা হলেও কোনো কাজের কাজ হয়না। ঠিকাদার খায় আর খায়। ঠিকাদারদের ভাগ্য বদলালেও আমাদের ভাগ্য আজও একই রকম আছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘মরলে তো মোরা মরমু, হ্যারাতো (ঠিকাদার) মরবেনা।’ এসময় তিনি সরকারের কাছে দ্রুত স্থায়ী বেড়িবাঁধ মেরামতের দাবি জানান।কথা হয় আলমগীর ফকিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সিডরের সময় চোখে দেখছি কতোগুলো জীবন শেষ হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ না ভাঙলে এতো মানুষ মারা যাইতোনা। একই পরিবারের নয়জন মানুষও মরতে দেখেছি। আজও সেই বেড়িবাঁধ শক্তভাবে মেরামত হয়নি। নতুনভাবে কোনো জীবন শেষ হোক আমরা দেখতে চাইনা।পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সিদ্দিক মিয়ার বলেন, আমার এলাকায় এ বাঁধ। সিডরের সময় অনেক প্রাণহানি হয়েছে। সিডরের পরে কয়েকবার বাঁধ মেরামত হয়েছে। কিন্তু তার স্থায়িত্ব হচ্ছেনা। জিও ব্যাগগুলো দিচ্ছে তার মধ্যেও অনেক দুর্নীতি রয়েছে এবং নিম্নমানের। আমরা স্থায়ী বাঁধ চাই। ঠিকাদাররা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছে, আর মরছি আমরা। এটা হতে দেওয়া যায়না। সরকারের বিকল্প পথ ভাবা উচিত।বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সংকল্প ট্রাস্ট্রের নির্বাহী পরিচালক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বলেন, শক্ত বাঁধ হওয়া উচিত। যে বাঁধ হবে স্থায়িত্ব। স্থায়ী বাঁধ হলে নতুন করে কোনো প্রাণহানি হবে না। স্থায়ী বাঁধের জন্য সরকারকে নতুন কিছু ভাবতে হবে।