১০ মাসেও কার্যকর হয়নি ব্যাংক ঋণের সিঙ্গেল ডিজিট,সব সুবিধা পরিচালকদের
আলোকিত বার্তা:দশ মাসেও ঘোষিত সুদহার কার্যকর করেনি বেসরকারি খাতের ৩৯টি ব্যাংক। যদিও এর মধ্যে সিঙ্গেল ডিজিটে শিল্পঋণ দেয়ার দাবি করেছে ৭টি ব্যাংক। কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ীর অভিযোগ- তারা কেউ সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ পাচ্ছেন না।এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী ঘোষিত ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা বিলম্বের কারণে ভালো গ্রাহকরাও এখন কিস্তি পরিশোধ করছেন না। এর ফলে ব্যাংকিং খাতজুড়ে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কীভাবে অমান্য করে, এটাই বুঝে আসছে না।সংশ্লিষ্টরা বলছেন,সব সুবিধা ব্যাংকের পরিচালকরাই পাচ্ছেন। নিজেরা ভাগাভাগি করে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়ার পাশাপাশি এখন সিঙ্গেল ডিজিটেও ঋণ সুবিধা নিতে তারা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। অথচ বিনিময়ে তারা ভালো ঋণগ্রহীতাদের কিছুই দিলেন না। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী মহলে চরম ক্ষোভ-অসন্তোষ বিরাজ করছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা মঙ্গলবার আলোকিত বার্তাকে বলেন, যেসব ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে শিল্পঋণ দেয়ার দাবি করছে, তারা হয়তো তাদের পরিচালকদের এ সুবিধা দিচ্ছে। তার মতে, ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির মতো সিঙ্গেল ডিজিটের সুবিধাও এখন ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এরা রাজনৈতিকভাবে এতটাই প্রভাবশালী যে, বাংলাদেশ ব্যাংকও এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বুধবার আলোকিত বার্তাকে বলেন, ‘৯ শতাংশ সুদে কেউ শিল্পঋণ পাচ্ছেন, এটা আমি শুনিনি। ঋণের সুদ কমানোর ঘোষণার মধ্যেই উল্টো বাড়ছে। এটা খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কীভাবে অমান্য করছে, এটা বুঝতে পারছি না।এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম গতকাল যুগান্তরকে বলেন, ‘নগদ সহায়তার বিপরীতে ১৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে। ৯০ দিন মেয়াদি এ ঋণ আমি মাত্র ২০ দিনে পরিশোধ করে দেব বলেছি। তবুও প্রতি লাখে ৩ হাজার টাকা করে ৪৮ হাজার টাকা নিয়ে যাবে বলে চিঠি দিয়েছে ব্যাংক। এতে আমার কাছ থেকে তারা ৩৩ শতাংশ সুদ নেবে। এটা এক ধরনের ডাকাতি।’
তিনি জানান, এ ছাড়া তার লেনদেনকারী অন্য ব্যাংকগুলো তাকে ঋণের ক্ষেত্রে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এখন থেকে সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ নেবে। তিনি বলেন,এ ধরনের উচ্চসুদে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না। ধীরে ধীরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।এদিকে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ১২ বছরের পুনঃতফসিল সুবিধা পাবেন ঋণখেলাপিরা। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর দেয়া এমন ঘোষণার পর ব্যাংকিং সেক্টরের ভালো গ্রাহকরাও নড়েচড়ে বসেছেন। সঙ্গত কারণে তারাও এখন এ সুবিধা নিশ্চিত করতে চান। যে কারণে কিস্তি পরিশোধ স্থগিত রেখেছেন।কেননা, তারা মনে করেন,এতকাল ব্যাংকের ঋণের কিস্তি যথাসময়ে দিয়ে আসার পরও এখন যদি ঋণখেলাপিদের এমন সুবিধা দেয়া হয়, তাহলে ভালো গ্রাহকরা কেন চড়া সুদে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে যাবেন। বরং তাদেরকে আরও বেশি সুবিধা দেয়া উচিত।গত মার্চে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে শিল্পঋণ বিতরণ করেছে বলে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে।
এ সময় অন্য ৩২টি বেসরকারি ব্যাংক ১২ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত শিল্পঋণে সুদ নেয়ার তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। নিয়ম অনুযায়ী, সব ব্যাংক প্রত্যেক মাসের সুদহারের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হয়। ব্যাংকগুলোর পাঠানো প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।কিন্তু তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেয়ার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সেখানেও শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। সূত্র বলছে, ব্যাংকের পরিচালক ও নিজস্ব লোকজন ছাড়া অন্য কেউ এ সুবিধা পাচ্ছে না।গত বছরের জুলাই থেকে আমানতে সর্বোচ্চ ৬ এবং ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ কার্যকরের ঘোষণা দেন ব্যাংক মালিকরা। এর পূর্বশর্ত হিসেবে তারা ৫টি সুবিধা আদায় করে নেন। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের কর কমানো, নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) কমানো, সরকারি আমানতের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, রেপো রেট কমানো এবং ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়সীমা দফায় দফায় বাড়ানো।
এ ছাড়া টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা ও এক পরিবারের ৪ জনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগও করে দেয় সরকার। সব সুবিধা ইতিমধ্যে ভোগ করা শুরু করলেও কোনো ব্যাংকই নয়-ছয় সুদহার কার্যকর করেনি। আগে থেকে কয়েকটি খাতে কম সুদ ছিল সেগুলোকেই কার্যকর বলে উপস্থাপন করেছে কয়েকটি ব্যাংক।ব্যাংকের এমন কার্যক্রমে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ৩১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শিল্পমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘আমি মনে করি,আমাদের দেশে শিল্পায়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ব্যাংক ঋণ। ব্যাংকের ব্যাপারটা আমরা দেখছি। কয়েকদিন আগে আমরা বসেছিলাম, কীভাবে ব্যাংকের সুদের হার কমানো যায়।তিনি আরও বলেন,আমরা চেষ্টা করেছি। একবার উদ্যোগ নিলাম, সঙ্গে সঙ্গে কথাও বললাম। বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধাও করে দিলাম। যেমন আগে আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগ অর্থ সরকারি ব্যাংকে, ৩০ ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হতো।
ব্যাংক মালিকরা বললেন, এটা যদি ফিফটি-ফিফটি করে দেয়া হয় তাহলে আমরা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনব। সেটাও কিন্তু করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম এবং দিলাম। কিছু ব্যাংকে ঠিকই সুদের হার ৯ শতাংশে নামানো হল,কিন্তু সবাই তা করল না। বাড়াতে বাড়াতে ১৪, ১৫, ১৬-তে নিয়ে গেল। কেন করল না, তাদের এই সুযোগটা দেয়া সত্ত্বেও?সম্প্রতি এক প্রাক-বাজেট অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, একটি বিষয় সবাইকে স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের সুদের হারের মতো পৃথিবীর কোনো দেশে এত বেশি সুদহার নেই। এই সুদহার ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৮ শতাংশ পর্যন্ত। এত পরিমাণ সুদ দিয়ে কোনোদিন শিল্পকারখানা টিকে থাকতে পারে না। আমি নিজেও একসময় ব্যবসায়ী ছিলাম। আমারও কিছু কারখানা ছিল। আমি নিজেও সুদ দিতে পারিনি। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সুদ দিতে পারে এমন নজির থাকে না। কারণ হচ্ছে সুদের হার বেশি ও ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন,ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে কিস্তি পরিশোধ করলে সেখানে আগে সুদ কেটে রাখা হয়। ফলে প্রিন্সিপাল (প্রকৃত ঋণ) কমে না। এ ধরনের অনেক অভিযোগ আমার কাছে আছে। অনেকে বলেন, ঋণ নিয়েছি ৫ কোটি টাকা, ১৫ কোটি টাকা পরিশোধের পরও ১০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এর কারণগুলো আমার জানা আছে। এই অস্বাভাবিক সুদহার কমাতে পারলে কেউ আর ঋণখেলাপি হবেন না।সূত্র জানায়,তারল্য সংকটের কারণে গোপনে গোপনে বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করেছে কিছু ব্যাংক। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে গোপনীয়তা ছেড়ে প্রকাশ্যে শর্তভঙ্গ শুরু করে কয়েকটি ব্যাংক। রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আমানতের সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেয় একটি ব্যাংক।
ব্যাংকটি ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ মুনাফায় আমানত সংগ্রহের বিজ্ঞাপন প্রচার করে। এরপর অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক একই পথে পা বাড়ায়। এমনকি আমানতের বিপরীতে প্রায় ১৩ শতাংশ সুদ দেয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে নতুন আসা একটি ব্যাংক।ব্যাংকটির মাসিক জমায় (ডিপিএস) সুদ দিচ্ছে ৯ থেকে ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। পাঁচ বছর দশ মাসে জমাকৃত আমানত দ্বিগুণ এবং ৯ বছরে তিন গুণ হবে- এমন ঘোষণাও দেয়া হয়েছে।এতে সুদহার দাঁড়ায় যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গত ২৫ এপ্রিল থেকে এই নীতি লঙ্ঘনের সুদহার কার্যকর করেছে ব্যাংকটি।এখন প্রশ্ন হল- যদি এই হারে সুদ দিয়ে কোনো ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করে, তাহলে সেই ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণের সুদ নেবে কীভাবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এক ধরনের দুঃসাহস দেখাচ্ছে, যা কখনও কাম্য হতে পারে না।
প্রসঙ্গত, গত বছরের বাজেট ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ।পরে তিনি সুদের হার কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যে ২০ জুন এক বৈঠক থেকে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১ জুলাই থেকে ঋণের সুদ হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং ছয় মাস মেয়াদি আমানতের সুদ হবে সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ।একই ঘোষণা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও দিয়েছে। এটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় গত বছরের ২ আগস্ট আবার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈঠক ডাকেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষের ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিব, সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং এমডির উপস্থিতিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এটা ৯ আগস্ট থেকে সব ব্যাংকে কার্যকর করতে হবে।ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকগুলো সুদের হার কমালেও বেসরকারি খাতের কোনো ব্যাংকই তা কমায়নি। এ অবস্থায় ব্যাংকিং সেক্টরের বিদ্যমান গভীর সংকটের কীভাবে উত্তরণ ঘটবে সেটিই এখন দেখার বিষয়।