অংশগ্রহণে পূর্ণতা পেল সংসদ নির্বাচনের পর সব দলের
আলোকিত বার্তা:নির্ধারিত মেয়াদের শেষদিন নাটকীয়ভাবে বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নেয়ায় রাজনীতিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচনের পর সব দলের সদস্যরা সংসদে যোগ দিলেন। এতে জাতীয় সংসদ পূর্ণতা পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।তাদের মতে,বিএনপি সংসদে যাওয়ায় একপেশে নির্বাচনের দায় থেকেও রক্ষা পাচ্ছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপিও সংসদ বর্জনের দায় থেকে রক্ষা পাবে।সংসদে সব দল অংশ নেয়ায় রাজপথে সহিংস রাজনীতির শঙ্কা অনেকটা দূর হয়েছে বলে মনে করেন তারা। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এখন সংসদের ভেতরে এবং রাজপথে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ পাবে। যা সংদীয় গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক। সব মিলিয়ে দেশের রাজনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরছে বলে তারা মনে করেন।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, 3০ ডিসেম্বর দেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন হয়। এর পরপরই পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়ে ওঠে। বিরোধীপক্ষ কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করে। সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।ফলে বিএনপি ছাড়াই শুরু হয় একাদশ সংসদের পথচলা। কিন্তু সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে অধিবেশন শুরুর ৯০তম দিনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া অন্য নির্বাচিতরা সংসদে যোগ দেন। এর মধ্য দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ নির্বাচনের পর সব দলের অংশগ্রহণে সংসদের যাত্রা শুরু হয়।এতেই সংসদীয় গণতন্ত্র আক্ষরিক অর্থে পূর্ণতা পেয়েছে বলে তারা মনে করছেন। এ অবস্থায় রাজনীতিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দলগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আলোকিত বার্তাকে বলেন,শেষ মুহূর্তে বিএনপির সংসদে যাওয়া রাজনীতির জন্য ইতিবাচক লক্ষণ। রাজনীতিতে যতই মতপার্থক্য থাকুক,মূল প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকব- এ শুভবুদ্ধি যেন সব সময় কার্যকর থাকে। তিনি বলেন,নির্বাচনের পর বিএনপি সংসদে যেতে চায়নি।কারণ,শপথ নিলে এ সংসদকে বৈধতা দেয়া হবে। এখন যখন শপথ নিয়েছে তখন বলা যায়, প্রকারান্তরে এ সংসদকে বৈধতা দেয়া হল। সব দলের অংশগ্রহণে সংসদও পূর্ণতা পেয়েছে।
আনোয়ার হোসেন বলেন,কোনো দলের প্রার্থী যখন মনোনীত হন তখন তারা দলীয় প্রার্থী থাকেন না। তখন তারা জনগণের সম্পত্তি হয়ে যায়- এ কারণে তাদের জনপ্রতিনিধি বলা হয়। তখন দলের চেয়ে জনগণের প্রতি তাদের আনুগত্য বেশি থাকা দরকার।আর বিএনপির দলীয় আদর্শেই রয়েছে দলের চেয়ে দেশ বড়। সেদিক থেকে শপথ গ্রহণ সঠিক হয়েছে। সংসদে গিয়ে তাদের বক্তব্য ভালোভাবে যুক্তিসহকারে যদি তুলে ধরতে পারে, তাহলে তারা সঠিক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারবে। যা গণতন্ত্র ও তাদের দলের জন্য অনেক কার্যকর হবে।তিনি আরও বলেন, রাজনীতিতে ইতিবাচক ধারা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কার্যকর করতে হলে নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেদিকে সবাইকে নজর দিতে হবে। সরকার ও বিরোধী দল উভয়কে চেষ্টা করতে হবে নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণে ভোটাররা বিমুখ হয়ে যায় যা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।বিশ্লেষকরা মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে চলা বৈরিতা এর মধ্য দিয়ে কমতে শুরু করবে। ২০১৪ সালের দশম নির্বাচনের আগে ও পরে রাজনীতিতে যে সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে সরে আসছে দলগুলো। বিশেষ করে মাঠের বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতি অনেকটা ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া পরের নির্বাচনে বিএনপি যাবে না বলে অনেকের সন্দেহ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বর্তমান সরকারের অধীনেই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচন নিয়ে নানা কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে তা প্রত্যাখ্যান করে দলটি।অনেকের আশঙ্কা ছিল- এ ইস্যুতে তারা রাজপথে আবারও জ্বালাও-পোড়াওর রাজনীতি শুরু করবে। কিন্তু তারা সেদিকে পা বাড়ায়নি। গণতান্ত্রিকভাবে তারা নির্বাচনে অনিয়মের প্রতিবাদ করেছে। নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার পর দলটির নির্বাচিতরা সংসদে যাবে কি না, তা নিয়েও নানা সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা নাটকীয়তার পর তারা সংসদে যোগ দিয়েছে।জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ আলোকিত বার্তাকে বলেন, বিএনপি সংসদে গিয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের রাজনীতি ইতিবাচক ধারার দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ সমঝোতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকলে দেশের জন্য মঙ্গল। এ ক্ষেত্রে সরকারকেও উদারতার পরিচয় দিতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিগত নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ছয়টি আসনে জয়লাভ করেছে। এত অল্পসংখ্যক নির্বাচিতরা সংসদে না গেলে সংসদ পরিচালনায় তেমন প্রভাব পড়বে না। কিন্তু সামগ্রিক রাজনীতিতে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা ছিল। তারা সংখ্যায় ছয় হলেও দলটি বিএনপি।রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা দেশের কল্যাণ কিংবা অস্থিতিশীলতা সবকিছুই আওয়ামী লীগ বিএনপিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর এ দুটি দলের উপস্থিতি ছাড়া সংসদ কখনও প্রাণ পায়নি। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে। পাঁচ কিংবা ছয়জন সংসদে গিয়েছে- সাধারণ মানুষ এমনটা মনে করবে না। তারা মনে করবে, দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি সংসদে যোগ দিয়েছে।সংশ্লিষ্টরা মনে করেন,ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যেও সেই বিষয়টি ফুটে উঠেছে। নির্বাচনের পর থেকে বিএনপিকে শপথ নিতে তারা নানাভাবে আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সংখ্যার দিক থেকে অল্প কয়েকজন নির্বাচিতকে শপথ নেয়ার আহ্বান জানানোর তেমন প্রয়োজন ছিল না।
কিন্তু তারা সংখ্যা বিবেচনায় নয়, দল হিসেবে বিএনপিকে সংসদে পেতে চাইছিল। কারণ বিএনপি ছাড়া সংসদের পূর্ণতা সম্ভব নয়। বিএনপির নির্বাচিতরা শপথ নেয়ায় ক্ষমতাসীন দলও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান আলোকিত বার্তাকে বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশবাসীর মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকে অনেকে নানাভাবে দেখছেন। নির্বাচনের পরপরই তারা এ ব্যাপারে আরও কৌশলী হতে পারত।বিএনপি সংসদে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে সেটাই এখন প্রশ্ন। তবে যতটুকুই রাখুক তারা সংসদে গিয়েছে এটা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক দিক। এর মধ্য দিয়ে অন্তত দু’দলের পরস্পরবিরোধী মনোভাবের কারণে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও বা ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করার সুযোগ তৃতীয় পক্ষ পাবে না।বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনীতিতে ইতিবাচক ধারা প্রবাহিত হওয়ায় অনেক কিছুই হতে পারে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন বা প্যারোল, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসার বিষয়টিও সমঝোতা হতে পারে। বুধবার উচ্চ আদালতে খালেদা জিয়ার আপিল ও জামিন সংক্রান্ত শুনানির বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন অনেকে।তাদের মতে, আদালত শুরুতেই খালেদা জিয়ার অর্থদণ্ড স্থগিত করেছেন। জামিনের বিষয়টি সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে এ ব্যাপারে কিছু মন্তব্য করেন আদালত। জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় জামিন দিলেই এ মুহূর্তে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না। কারণ তার বিরুদ্ধে আরও মামলা রয়েছে। আদালতের এমন বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তারা।সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায় এক যুগের উপরে নির্বাসিত হয়ে আছেন।
প্রতি মুহূর্তে তিনি দেশের কথা চিন্তা করছেন, দলের কথা চিন্তা করছেন। তিনি ভাবছেন কীভাবে দেশে ফিরে আসা যায়। তার এমন মন্তব্যের পর তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও শুরু হয়েছে গুঞ্জন।সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, তারেক রহমানকে দেশে ফিরে আসতে হলে সমঝোতার মধ্য দিয়েই আসতে হবে। কারণ, তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। কয়েকটি মামলায় সাজাও হয়েছে। সমঝোতা ছাড়া দেশে ফিরলে তাকে কারাগারে যেতে হবে।এ প্রসঙ্গে এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়টি হয়তো হবে না। তিনি জামিন পেতে পারেন। আর তারেক রহমানের দেশে ফেরা এত সহজ হবে না। তবে এসব বিষয় স্পষ্ট হতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা যুগান্তরকে জানান, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে দীর্ঘদিন ধরেই দেশি-বিদেশিদের চাপ অব্যাহত ছিল এবং এখনও আছে।
আন্দোলনের নামে যাতে জ্বালাও-পোড়াও কিংবা জীবনহানি না ঘটে সে বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ রয়েছে। বিপরীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য যেটুকু স্পেস বা সুযোগ থাকা প্রয়োজন সে বিষয়েও দেশের সুশীল সমাজসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর জোরালো আহ্বান অব্যাহত রয়েছে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও মনে করেন, শুধু বিএনপি চাইলেই ইতিবাচক রাজনীতির পরিবেশ কখনও নিশ্চিত করতে পারবে না। এ জন্য সরকারি দলের ভূমিকা রাখতে হবে বেশি।বিএনপির নির্বাচিতদের শপথ নেয়াটা রাজনীতির জন্য চমক ও ইউটার্ন মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার এক আলোচনা সভায় বলেন, আমরা যে শপথ নিয়েছি, এর জন্য অনেকে অনেক মন্তব্য করেছেন।কিন্তু সময়ই প্রমাণ করবে, শপথ নেয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত কি না। আগে আমরা শপথ নিইনি, তার মানে এখন নেব না, তা তো হতে পারে না। আমাদের ন্যূনতম যে সুযোগটুকু আছে সংসদে গিয়ে কথা বলার, সেটা কাজে লাগাব।