দেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য - Alokitobarta
আজ : রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :দেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। সেই সঙ্গে গ্রামে বেড়েছে মানুষের খরচ। পাশাপাশি বেড়ে গেছে পরিবারভিত্তিক ঋণ গ্রহণও। এছাড়া ঋণ করে সংসার চালায় দেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ। একটি পরিবারের ঋণ ৭৩ হাজার ৯৮০ এবং মাথাপিছু ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলোর ঋণ ২১০ শতাংশ বেশি। এছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাও বেশি। পাশাপাশি ভাত খাওয়া কমেছে, বেড়েছে অন্যান্য খাদ্য গ্রহণ। ২০২২ সালের হিসাবে এসব তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বুধবার খানা আয়ব্যয় জরিপ-২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। এর মধ্যে পল্লি অঞ্চলে ২০ দশমিক ৫ এবং শহরে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। তবে ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ এবং ২০১০ সালের হিসাবে ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে দেশে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ (হ্রাসের গতি) কমেছে। এছাড়া অতিদারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। এক্ষেত্রে পল্লি এলাকায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এদিকে ২০২২ সালের হিসাবে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। যেটি গিনি সহগের মান (বিশ্বব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি) শূন্য দশমিক ৪৯৯, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২। ২০১০ সালে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। অন্যদিকে বেড়েছে ভোগবৈষম্যও। ২০২২ সালের হিসাবে ভোগব্যয়ের জন্য গিনি সহগের মান শূন্য ৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪। তবে ২০১০ সালে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৩২১। এছাড়া দেশের সর্বোচ্চ ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ। অপরদিকে সর্বনিম্নে থাকা ৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় মোট আয়ের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। এখানে স্পষ্ট হয়েছে যে, ধনীদের আয় বাড়ছে উচ্চহারে আর গরিবদের বাড়ছে ধীরে। এ দুই অংশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিরাজ করছে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে ভিডিওবার্তায় বক্তব্য দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সচিব) ড. মো. কাউছার আহমেদ। বিবিএস-এর মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য দেন বিবিএস-এর উপমহাপরিচালক পরিমল চন্দ্র বসু, মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভের প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ। প্রশ্ন-উত্তর পর্ব পরিচালনা করেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্মসচিব ড. দিপঙ্কর রায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে ভিন্নচিত্র বরিশালে। আগে কুড়িগ্রামে সর্বোচ্চ দরিদ্র মানুষের বাস থাকলেও এবার উঠে এসেছে বরিশালে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। রংপুর থেকে এখন দারিদ্র্য বরিশালে গেছে। একসময় রংপুর বিভাগের মানুষ বেশি গরিব ছিল। দারিদ্র্যের হারও ওই অঞ্চলে বেশি ছিল। এখন দেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার বরিশাল বিভাগে। বরিশাল অঞ্চলটি শস্যভান্ডার হিসাবে পরিচিত। সেখানে দারিদ্র্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে ওই বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম পার্শ্ববর্তী খুলনা বিভাগে। এ বিভাগের দারিদ্র্যের হার ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালে জাতীয়ভাবে প্রতিটি পরিবারের গড় ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। গড়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ দশমিক ২৬ ধরে মাথাপিছু ঋণ দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০২৬ সালে জরিপে ছিল পরিবারপ্রতি ঋণের পরিমাণ ৩৭ হাজার ২৪৩ টাকা। মাথাপিছু ঋণ ছিল ৯ হাজার ১৭৩ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে প্রতিটি পরিবারের ঋণ বেড়েছে ১১১ দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারের ঋণ বেড়েছে। ২০২২ সালের হিসাবে গ্রামে পরিবারপ্রতি ঋণ ৪৪ হাজার ৪১১ টাকা, সেখানে শহরে পরিবারপ্রতি গড় ঋণ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৫৬ টাকা। এটি গ্রামের তুলনায় তিনগুণ বেশি।

আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালে আনুমানিক ১৪ দশমিক এক শতাংশ খানার একজন সদস্য ছিলেন যারা ১২ মাসে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। এটি ২০১৬ ও ২০১০ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, যার হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে ২১ দশমিক ১১ শতাংশ ব্যক্তি মাঝারি বা মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। যেখানে ২০২২ সালে পল্লি এলাকায় এ হার ছিল ২২ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দেশে ২০২২ সালে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ ব্যক্তি মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিলেন। এখন ভাতের প্রতি মানুষের চাহিদা কমেছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ২০২২ সালে চালের দৈনিক মাথাপিছু গড় ভোগের পরিমাণ ছিল ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। ২০২৬ সালে এটি ছিল ৩৬৭ দশমিক ২ গ্রাম। ২০১০ সালে ছিল ৪১৬ গ্রাম এবং ২০০৫ সালে ৪৩৯ দশমিক ৬ গ্রাম। এর বিপরীতে ফল, সবজি ও মাংসের ভোগ বাড়ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে মানুষ খাদ্যপণ্য কিনতে বেশি টাকা ব্যয় করলেও এখন খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ক্রয়ে বেশি টাকা ব্যয় করছে। ২০২২ সালের হিসাবে খাদ্যব্যয়ের শতকরা হার হচ্ছে ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হয়েছে ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে ২০১৬ সালে খাদ্যের জন্য ব্যয় হতো ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় ছিল ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ।

প্রকাশনা অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, সঠিক তথ্য তুলে এনে উন্নত পরিকল্পনা করতে সহায়তা করছে বিবিএস। দারিদ্র্য যে কমছে, সেটি এ প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে। সঠিক তথ্য পেতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ চলছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বেশি খুলনা জেলায়। সেখানে দারিদ্র্যের হার বেশি হারে বাড়ার কথা। কিন্তু পাশের বিভাগে দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি। দারিদ্র্য কমানোর প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা বেশি জরুরি। কারণ, হঠাৎ যে কোনো ধরনের আঘাতে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারেন। তাদের সুরক্ষা দিতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচন টেকসই হবে। সমাজের একটি বড় অংশই এ জায়গায় অবস্থান করে। তাদের নিম্নমধ্যবিত্তও বলা হয়। জিইডিস সদস্য ড. কাউছার আহমেদ বলেন, আগে আমরা তিন বেলাই ডাল-ভাত খেতাম। এখন মানুষ ভাত খায় কম। ডায়াবেটিসসহ নানা কারণে মানুষের ভাতের প্রতি আকর্ষণ কমছে। সেটির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে প্রতিবেদনে। আগে বছরে একটি কাপড় অথবা দুই ঈদে দুটি কাপড় কেনা হতো। এখন মানুষের আয় বেড়েছে বলেই কোট, টাইসহ আর নানা ধরনের পোশাক কেনা হচ্ছে। এভাবে দিনদিন খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় বাড়ছে।

আরও পড়ুন...
Top
%d bloggers like this: