‘আঁতুড়ঘর’১২০ সুপারিশ নিয়োগ দুর্নীতির
আলোকিত বার্তা:সরকারি,আধা-সরকারি,স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থায় নিয়োগে দুর্নীতি-অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। দুদকের কাছে নিয়োগে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ আসছে। দুদক যাচাই-বাছাই করে নিয়োগে দুর্নীতির সত্যতাও পেয়েছে।সোমবার রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৮) উঠে এসেছে এসব তথ্য। এদিন বিকালে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে কমিশনের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে এ প্রতিবেদন পেশ করে।নিয়োগে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির ‘আঁতুড়ঘর’- এমন মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ দুর্নীতি এখনই বন্ধ করতে হবে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেয়া হলে যোগ্য ও মেধাবী সন্তানরা দেশের জন্য কিছু দিতে পারবেন। নিজেদের আত্মমর্যাদাশীল কর্মচারী হিসেবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন।নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধে বেশকিছু সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের ১৩৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে এক বা একাধিক সরকারি কর্মকমিশন গঠন করা যেতে পারে। এটা করা গেলে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য ‘উপযুক্ত’ ব্যক্তিকে মনোনয়নের উদ্দেশ্যে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
এক্ষেত্রে সংবিধানের ১৪০(১)(গ) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোও প্রণয়নের সুযোগ রয়েছে। দুদকের ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধের সুপারিশ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা ও শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পাসপোর্ট, বিমান ও সিভিল এভিয়েশন, ভূমি, বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতি ও সরকারি সেবা প্রদানে পদ্ধতিগত ত্রুটি তুলে ধরে তা নিরসনে ১২০ দফা সুপারিশ করা হয়।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও ছাত্র ভর্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুলিশ বিভাগে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি বন্ধে থানার ওসি হিসেবে অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদায়নের ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয় দুদকের সুপারিশে।এছাড়া সরকারি দফতরে দুর্নীতিমুক্ত সেবা প্রদান এবং দুর্নীতি বন্ধে মন্ত্রণালয়সহ সব সরকারি দফতরে যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি করে উন্নয়ন টিম গঠন করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি সেবা প্রদানে পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণেই অধিকাংশ দুর্নীতি সংঘটিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্য সম্পাদন সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণেও বিঘ্ন ঘটছে। ফলে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি এবং দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে।
বঙ্গভবন থেকে বের হওয়ার পর দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন,রাষ্ট্রপতি দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদককে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি অনুসরণ করতে বলেছেন। তিনি শ্রেণীকক্ষে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য করণীয় সবকিছু করতে পরামর্শ প্রদান করেছেন।এছাড়া রাষ্ট্রপতি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও দুর্নীতি নির্মূলে কমিশনকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পেতে হলে স্বাস্থ্য এবং মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত কর্মীদের যদি কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের খবর আসে তাও যেন কমিশনের নজরে থাকে সে বিষয়েও রাষ্ট্রপতি পরামর্শ প্রদান করেছেন।
দুদক সরকারের তল্পিবাহক এমন এক প্রশ্নের উত্তরে দুদক চেয়ারম্যান বলেন,অসম্ভব। দুদক কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। যে কারণে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল না করে রাষ্ট্রপতির কাছে বঙ্গভবনে এসে দাখিল করছি। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে দুদকের সরকার বা অন্য কোনো সংস্থার তল্পিবাহক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়,শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কারণে তারা আর্থিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। অভিভাবকরাও আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির শিকার হন। বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সমন্বিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভর্তি সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।একইভাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত একক পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি সমন্বি^ত ভর্তি নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে।বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি :দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শিক্ষার মানদণ্ডে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের অতীত ঐতিহ্যও হারাতে বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে।
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ম্লান করে দিচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সর্বোচ্চ মেধাবী এবং যোগ্য প্রার্থীরাই শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন।আইনশৃঙ্খলা : প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের পুলিশি সেবার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে থানা। প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশের পরিদর্শক (নন-ক্যাডার) পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। কিন্তু সেবাপ্রার্থী নাগরিকরা থানা থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার সেবা পাচ্ছেন না।
কোনো ক্ষেত্রে আচরণ খারাপ করা, হয়রানি করা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। এক্ষেত্রে সমাধানের পথ দেখিয়েছে দুদক। সুপারিশে বলা হয়েছে- উপজেলা পর্যায়ে অধিকাংশ দফতরেই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন।তাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পুলিশ) ক্যাডারের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ অথবা অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদায়নের ব্যবস্থা করা। থানায় ক্যাডার অফিসার নিয়োগের বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে পুলিশের প্রতি জনআস্থাকে আরও বিকশিত করা এবং উপজেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে কার্যকর সমন্বয়ের জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পুলিশ) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়নের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারে।রাষ্ট্রপতিকে দেয়া এ প্রতিবেদনে দুদক ভূমি ব্যবস্থাপনা, পাসপোর্ট প্রদান সহজীকরণ, স্বাস্থ্য, আয়কর, হিসাবরক্ষণ অফিস, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, সরকারি নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা, মন্ত্রণালয়ের কার্যোন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম এবং জনহয়রানির সম্ভাব্য উৎস চিহ্নিত করেছে।
এছাড়া ভূমি রেজিস্ট্রেশন, ভূমি অধিগ্রহণ, নামজারি, ভূমি-কর, ভূমি রেকর্ড, খাস জমি, পরিত্যক্ত ও অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি বন্ধে দুদক বেশ কিছু সুপারিশ করে। এর মধ্যে রয়েছে- আয়কর মেলার আদলে প্রতি বছর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রেশন অফিস এবং ভূমি জরিপ অধিদফতরের যৌথ উদ্যোগে ‘ভূমি সেবা মেলা’ আয়োজন করা।প্রতিবেদনে পাসপোর্ট খাতে দুর্নীতি বন্ধে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- গেজেটেড কর্মকর্তা কর্তৃক আবেদনপত্র এবং ছবি সত্যায়ন করার প্রক্রিয়া বিলুপ্ত করা। পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রথা বাতিলসহ পাসপোর্টের মেয়াদ ১০ বছর করা।
জাতীয় নিরাপত্তা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে ডিজিটাল পাসপোর্ট ব্যবস্থা প্রচলন করা। পর্যায়ক্রমে আবেদনপত্র ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় প্রসেস করা। পাসপোর্ট অফিসে ভিড় এড়ানো এবং কাউন্টারভিত্তিক সেবা প্রদান সহজতর করতে (ইলেকট্রনিক কিউইউ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) ‘ইকিউএমএস’ চালু করতে হবে।অধিদফতরে আবেদনের পদ্ধতি, ফরমের প্রাপ্যতা, ফিস প্রদানের কেন্দ্র, অফিস সময়সূচি, সেবাপ্রাপ্তির সুনির্দিষ্ট সময় পুস্তিকা আকারে সংক্ষিপ্তভাবে মুদ্রণ করে জনসাধারণের সুবিধার্থে বিনামূল্যে বিতরণ করা যেতে পারে। জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা এবং সাহায্য ডেস্ক স্থাপন করা যেতে পারে। আরও বেশিসংখ্যক ব্যাংকের শাখাকে ফিস গ্রহণের অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।এছাড়া প্রতিবেদনে দুদকের এক বছরের কার্যক্রমের পুরো বিবরণও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলা ও চার্জশিটের সংখ্য কমেছে।