তলবের ক্ষমতা চায় দুদক আয়কর রিটার্ন ও ব্যাংক হিসাব



আলোকিত বার্তা:দুর্নীতির তথ্য অনুসন্ধানে করদাতার আয়করের রিটার্ন ফাইল এবং ব্যাংক হিসাব তলবের ক্ষমতা চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এজন্য বিদ্যমান দুদক আইনের বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।কার্যকরভাবে দুর্নীতি দমন করতেই মূলত এ উদ্যোগ। তবে এ ব্যাপারে নানা শঙ্কা ও উদ্বেগের কথা বলছেন ব্যবসায়ী এবং ব্যাংক ও এনবিআর সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, প্রস্তবিত বিধানটি আয়কর আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি দুদককে এ ক্ষমতা দেয়া হলে করদাতার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমবে এবং অর্থ পাচার বাড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যাংকিং খাত।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদক আইনের সংশোধিত বিধিমালাটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। ভেটিং শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত এক সভায় করদাতার রিটার্নের মতো গোপনীয় তথ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত দুদকের প্রস্তাবের বিষয়ে এনবিআরের পক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি জানানো হয়।
ওই বৈঠকে অংশ নেয়া এনবিআরের আয়কর বিভাগের একজন কর্মকর্তা আলোকিত বার্তাকে বলেন, করদাতাদের হয়রানি না করার আশ্বাস দিয়ে নতুন করদাতা সংগ্রহ করার লক্ষ্যে সারা দেশে আয়কর জরিপ চলছে।এরই মধ্যে দুদকের এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে করদাতা সংগ্রহ করার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। করদাতাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হবে এবং নতুন করদাতা সংগ্রহে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি বিদ্যমান করদাতারা তাদের সম্পদের তথ্য দেবে না। এতে কর ফাঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কাকে উসকে দেবে।বর্তমান বিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির দুর্নীতির তথ্য অনুসন্ধানের স্বার্থে দুদক ওই ব্যক্তির কাছ থেকে আয়কর রিটার্নের সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তী সময়ে আয়কর অফিস থেকে ওই সার্টিফাইড কপির সত্যতা নিশ্চিত করেন।আর ব্যাংক হিসাবের তথ্য জানার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে তা সংগ্রহ করা হয়। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী, দুদক সরাসরি ব্যক্তির করদাতার তথ্য আয়কর অফিস থেকে এবং ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখা থেকে চাইতে পারবে।প্রস্তাবিত দুদক বিধিমালায় বলা হয়েছে, অনুসন্ধান বা তদন্তকাজে নিয়োজিত কমিশনের অনুসন্ধানকারী বা তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রয়োজনে ব্যাংকার্স মুদ্রণ (ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স আইন, ১৮৯১) বা আয়কর অফিস থেকে করদাতার আয়কর রিটার্ন, বিবরণীর হিসাব, সাক্ষ্যপ্রমাণ, অ্যাসেসমেন্ট নথি উদ্ঘাটন বা পরীক্ষা বা জব্দ বা তলব করতে পারবে। এক্ষেত্রে অন্য কোনো আইনের বিধান বাধা হবে না।অন্যদিকে আয়কর অধ্যাদেশের ১৬৩ ধারায় করদাতার বিবৃতি, রিটার্ন গোপনীয় রাখার কথা বলা আছে। এ ধারায় বলা আছে, সাক্ষ্য আইন বা বর্তমানে কার্যকর অন্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন- কোনো আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ আয়কর অধ্যাদেশের অধীনে পরিচালিত কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেকর্ড বা কোনো রিটার্ন, হিসাব-বহি বা দলিলপত্রের অংশবিশেষ সাক্ষ্য প্রদানার্থে তলব করার ক্ষমতা প্রদান করবে না। অর্থাৎ করদাতার রিটার্নের তথ্য অতি গোপনীয় বিষয়, বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত এটি কোনো দফতর চাইতে পারবে না।
এদিকে সিভিল সার্ভিস (ট্যাকসেশন) অ্যাসোসিয়েশন থেকে সোমবার এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে দুদক বিধিমালা সংশোধনে উদ্বেগ জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একজন করদাতা তার কর নথিতে ব্যক্তিগতসহ সব ধরনের তথ্য দিয়ে থাকেন। যেমন করদাতার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও সম্পদের তথ্য দেন, যা আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী গোপনীয়।এ গোপনীয়তা সুরক্ষিত না হলে করদাতার জন্য ব্যক্তিগত অস্বস্তির কারণ হতে পারে। যদি করদাতার তথ্য গোপন না থাকে, সেক্ষেত্রে করদাতা আয়কর বিভাগের কাছে তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকবেন। এক্ষেত্রে তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে যথাযথ কর আদায় ব্যাহত হতে পারে। এটা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত যে, করদাতার তথ্যের গোপনীয় শিথিল হলে কর পরিপালক ও কর আদায় হ্রাস পায়।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, করদাতার তথ্য সংরক্ষণ ও গোপনীয়তার বিদ্যমান বিধান পরিবর্তন হলে করদাতাদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হবে, করবান্ধব পরিবেশ ব্যাহত হবে, কর পরিপালক হ্রাস পাবে এবং রাজস্ব আদায়ে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকবে। এ অবস্থায় দুদক বিধিমালায় আয়কর বিভাগ থেকে তথ্য সরবরাহের বিধান সংযোজনের প্রস্তাবের বিষয়ে আপত্তি জানানোর জন্য অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়ার পরমর্শ দেয়া হয় স্মারকলিপিতে।আয়কর রিটার্ন ও ব্যাংক হিসাব তলব সংক্রান্ত প্রস্তাবিত বিধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন বিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) মঈদুল ইসলাম সোমবার টেলিফোনে আলোকিত বার্তাকে বলেন, ২০১৭ সাল থেকে দুদক বিধি সংশোধনের কাজ চলছে। দুর্নীতি কার্যকরভাবে দমনের জন্যই এই প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটি আইনসম্মত। ট্যাকসেশন অ্যাসোসিয়েশনের দাবি মোটেও আইনসম্মত নয়, অযৌক্তিক।তিনি বলেন, আয়কর অধ্যাদেশের ১৬৩(২) ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তির আয়কর রিটার্ন ও ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত তথ্য কোর্টে দেয়া যাবে। পাশাপাশি ৩ উপধারার (এন) অনুযায়ী আমরা তথ্য নিতে পারব।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান আলোকিত বার্তাকে বলেন, ব্যাংকিং খাত টিকে আছে বিশ্বাসের ওপর। একজন আমানতকারী তার তথ্যের গোপনীয়তা চাইবে। সে প্রতিশ্রুতি বা নিশ্চয়তা নিয়েই মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখে। এখন আইন পরিবর্তন করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত হলে মানুষের সেই বিশ্বাসে চিড় ধরতে পারে। এতে ব্যাংকিং খাত কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন,এসব ব্যাপারে দুদকের হাতে ক্ষমতা দেয়া ঠিক হবে না। কারণ সব প্রতিষ্ঠান চলে আস্থার ভিত্তিতে। অন্যদিকে দুদককে সবাই ভয় পায়। সেখানে দুদককে এসব ক্ষমতা দেয়া হলে আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে। তাই সিস্টেম পরিবর্তন করে আস্থার সংকট সৃষ্টি করা ঠিক হবে না।
এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন,সরকারের সব প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া উচিত। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে তথ্য আদানপ্রদানের প্রয়োজনের জন্য একটা সিস্টেম থাকা দরকার। তবে দুদককে সরাসরি ব্যাংক হিসাব ও রিটার্ন তলবের ক্ষমতা দেয়া হলে শঙ্কা বাড়বে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন,কর ফাঁকি ও দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য বিধি সংশোধন করা হলে সমস্যা নেই। তবে এই বিধির অপব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করাও সম্ভব। তাই বিধি চূড়ান্ত করার আগে আরও পর্যালোচনা করা দরকার। প্রয়োজনে অংশীজনদের নিয়ে বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে।এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন,করদাতার তথ্যের গোপনীয়তা ভঙ্গ হলে রাজস্ব আদায় ও বিনিয়োগ ব্যাহত হওয়ার, সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার এবং দেশের আর্থিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।কারণ করদাতার স্থাবর, অস্থাবর সম্পদসহ আর্থিক ও ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অংশ। এই গোপনীয়তা সুরক্ষিত না হলে তা করদাতার জন্য ব্যক্তিগত হুমকির কারণ হতে পারে। কেননা এই তথ্য ব্যবহার করে করদাতাকে সামাজিকভাবে হেয় করা, আর্থিক ও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা যেতে পারে।উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারতে কর আইনে করদাতার দেয়া তথ্য আইন দ্বারা সংরক্ষিত। সেখানে কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা এমনকি কর সংশ্লিষ্ট বিশেষ আদালত ছাড়া অন্য কোনো আদালতও করদাতার তথ্য চাইতে পারে না।