মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বর্তমান সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরে
মহাব্বাতুল্লাহ: আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি বা ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস রেটিংস বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান কমানো যথাযথ হয়নি বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা বলেছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের যে সূচনা করেছে, তা মুডিস রেটিংসে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি।সম্প্রতি মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে। একই সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল থেকে ঋণাত্মক হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণমানও কমেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঋণমান নির্ণয়কারী রেটিংস সংস্থার ওই প্রতিবেদনের কারণে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা জোরদার হয়।এমন পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মুডিসের রেটিংস সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, মুডিস রেটিংসে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান কমানো যথাযথ হয়নি। সরকার ইতোমধ্যে যেসব সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, এর প্রতিফলন ঘটেনি প্রতিবেদনে।
এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক খাতের সংস্কার, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বর্তমান সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরে। এসব পদক্ষেপের সুফল ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে পড়েছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘আমরা আশা করি, মুডিস শিগ্গিরই বাংলাদেশ সফরের পর দেশের অর্থনীতির আরও ব্যাপকভাবে মূল্যায়ন করবে। তখন তারা সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও অভিজ্ঞ অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি পরামর্শ করবে। এর ফলে সরকারের নেওয়া নীতি ও উন্নয়নের সঠিক মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবে তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতি প্রতিরোধব্যবস্থা, নির্বাচন ও জনপ্রাশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মৌলিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থনীতি সামাল দেওয়া ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক বড় ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এরই মধ্যে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-ব্যাংকগুলোর সম্পদ মানের পর্যালোচনা (যা পরে ব্যাংক খাতের বড় সংস্কারের দিকে ধাবিত করবে), বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম শক্তিশালী এবং চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধার করা। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ এবং ন্যায়সংগত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারে টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। এসব টাস্কফোর্স কাজ শুরু করেছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনাও করছে। টাস্কফোর্সে সরকারে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী নেতা এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এসব উদ্যোগের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, যুক্তরাজ্য সরকার, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা যুক্ত রয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বলছে, সংস্কার কার্যক্রম অন্তর্ভুক্তিমূলক করার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে, আগের সরকারের আমলে গৃহীত ভুল পদক্ষেপের কারণে অর্থনৈতিক সম্ভাব্য ক্ষতি এড়ানো। দেশে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই প্রবৃদ্ধি ও ন্যায়সংগত সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকার সংস্কারকে অগ্রাধিকার ও বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এসব পদক্ষেপের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা নাও মিলতে পারে, তবে সেগুলো শক্তিশালী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও সামাজিক অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনবে। সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্যালান্স অব পেমেন্টে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রতিনিয়ত পতন, ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন। এছাড়া মূল্যস্ফীতির হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কষ্ট হচ্ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাহ্যিক খাতের সূচক স্থিতিশীল করার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে, এক্ষেত্রে প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি সহায়ক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি থেকে বিরত রয়েছে, এতে নিট রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারে স্থিতিশীল হয়েছে। এছাড়া ২৫০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ পরিশোধও করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব ইতিবাচক ফলে বোঝা যায়, বেশকিছু দুর্বলতা মোকাবিলা করা হয়েছে।
বিগত সরকারের আমলে কয়েকটি পরিবার ও গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট করায় আর্থিক খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের কার্যক্রম, তারল্য, ব্যবস্থাপনা ও কর্মক্ষমতা প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করায় প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়ার মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তার ব্যবস্থা করছে। এ ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক ইতোমধ্যে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে। তাদের নগদ প্রভাব ও প্রবাসী আয় বেড়েছে। ফলে আগের মতো আর অন্য ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তার প্রয়োজন হচ্ছে না ব্যাংকটির। আরও কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকদের আস্থা ফেরানোর দিকে এগোচ্ছে।
এই ইতিবাচক অগ্রগতির পরও কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য সংকট দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এছাড়া ব্যাংক খাতের সমস্যার গঠনমূলক সমাধানে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন ট্রেজারির সহায়তায় কৌশল তৈরি করা হচ্ছে। ব্যাংকব্যবস্থায় কোনো পদ্ধতিগত ঝুঁকি নেই এবং সংক্রামক প্রভাবও থাকবে না। যদিও ব্যাংক খাতের সূচকগুলো এখনো লক্ষণীয় উন্নতি করেনি, তবে আমরা প্রত্যাশা করি, অদূরভবিষ্যতে হবে।
ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকার। আগামী মাসগুলোয় মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চাহিদার দিক থেকে রাশ টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। সুদের হার বাজারভিত্তিক করার পাশাপাশি রাজস্ব ঘাটতি পূরণে টাকা ছাপানো বন্ধ, তিন ধাপে নীতি সুদ সাড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। পণ্যের জোগান বাড়াতে সারের মজুত বাড়ানোর পাশাপাশি, কৃষিপণ্যের আমদানি নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়ানো এবং নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক কমানো এবং বিলাসবহুল নয়, এমন পণ্য আমদানি এলসি মার্জিন বাদ দেওয়া হয়েছে। বড় বন্যার কারণে ফসল ও শাকসবজির ক্ষতির কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এরপরও গত তিন মাস খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমেছে। সরকার বিশ্বাস করে, বর্তমানে যে কৌশলে এগোনো হচ্ছে, তাতে মূল্যস্ফীতি টেকসইভাবে ৫ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাখ্যায় আরও বলছে, দেশের অর্থনীতি একটি বড় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে অর্থনীতির স্বার্থে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে। এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক ফল পেতে আরও সময় লাগবে। আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য দেশীয় রাজনৈতিক সমর্থন ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমর্থন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি বাড়াবে।