রেমিট্যান্সের বদলে দেশে আসছে স্বর্ণ - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদঃ
আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দূরদর্শী চিন্তার ফসল আমাদের বর্তমান স্মার্ট বিআরটিসি পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানোর সুপারিশ সাংবাদিকতার নামে ছ্যামরামি করে ক্লাস ফাঁকি দেয়া,তিনি এখন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক,তখন নানা প্রশ্ন ক্লাস শুরু হবে ৩০ জুলাই থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বারবার নীতি পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা সরকার তাদের প্রভুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপির আশায় গুড়েবালি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার্তা দিয়ে গেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে শতভাগ অভিযোজনে যাওয়া সম্ভব না দেশে এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি পশু প্রস্তুত আছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি

রেমিট্যান্সের বদলে দেশে আসছে স্বর্ণ


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :রেমিট্যান্সের বদলে দেশে আসছে স্বর্ণ। প্রবাসীরা আগে উপার্জিত অর্থ রেমিট্যান্স হিসাবে দেশে পাঠালেও এখন সেই বৈদেশিক মুদ্রায় স্বর্ণ কিনে দেশে নিয়ে আসছেন। এতে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা থেকে।কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এ কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ডলারের বিপরীতে কমে যাচ্ছে টাকার মান। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক অর্থনীতিতে। এ পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য সরকার থেকে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।ঢাকা কাস্টম হাউজের উপকমিশনার সানোয়ারুল কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিমাসে বৈধভাবে দেশে তিন মেট্রিক টন স্বর্ণ আসছে। ব্যবহারের জন্য স্বর্ণালংকার আনলে কর দিতে হয় না। কিন্তু স্বর্ণের বার বা বিস্কুট আনলে ভরিতে দুই হাজার টাকা কর দিতে হয়।সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটা কাজে লাগিয়ে প্রবাসীরা এখন বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে স্বর্ণ নিয়ে আসছেন। এতে তারা ব্যক্তিগতভাবে বেশি লাভবান হচ্ছেন; কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা হারিয়ে দেশের ক্ষতি হচ্ছে।প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন বাংলাদেশি নাগরিক বছরে তিন দফায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনতে পারেন। প্রতি দফায় ২০ ভরি বা ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণ আনার সুযোগ রয়েছে। স্বর্ণের বার বা বিস্কুট আনলে প্রতি ভরিতে দুই হাজার টাকা কর দিতে হয়। স্বর্ণালংকার আমদানিতে শুল্ক ছাড় থাকলেও এগুলো বেশি আনেন না প্রবাসীরা। তারা স্বর্ণের বার নিয়ে আসেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে ব্যাগেজ রুলের আওতায় প্রকৃতপক্ষে প্রতিমাসে বৈধভাবে ৪ হাজার কেজি থেকে সাড়ে চার হাজার কেজি (৪ থেকে সাড়ে ৪ মেট্রিক টন) পর্যন্ত স্বর্ণ আসছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি স্বর্ণ ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকা করে বেচাকেনা হচ্ছে। এ হিসাবে দাম পড়ে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বৈধভাবে প্রতিমাসে আড়াই হাজার কোটি টাকার স্বর্ণ দেশে আসছে।এগুলোর প্রায় সবই আনছেন প্রবাসীরা। বিমানবন্দর অতিক্রম করার পরই এসব স্বর্ণ স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ লাখ টাকা করে। কেজিতে মুনাফা হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। মুনাফার হার ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ।
এক্ষেত্রে তারা কয়েকভাবে লাভবান হচ্ছে। প্রথমত, কম দামে স্বর্ণ এনে বেশি দামে বিক্রি করছেন। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে ব্যাংকের চেয়ে বেশি দাম পাচ্ছেন। তৃতীয়ত, রেমিট্যান্সের অর্থ পেতে প্রবাসীকে কোনো খরচ করতে হচ্ছে না। ফলে প্রবাসীদের একটি অংশ এর যে কোনো একটি পথ বেছে নিয়ে এখন অর্থ পাঠাচ্ছেন। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স এলে প্রবাসীরা ডলারের বিপরীতে বেশি দাম পাচ্ছেন।ব্যাংকে পাচ্ছেন ৮৬ টাকা। হুন্ডিতে এলে পাচ্ছেন ৯০ থেকে ৯২ টাকা। অর্থাৎ ৪ থেকে ৬ টাকা বেশি পাচ্ছেন। এ কারণে হুন্ডির রেমিট্যান্স দিয়ে অনেকে স্বর্ণ কিনে দেশে পাঠাচ্ছেন।এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বর্ণ হচ্ছে হার্ড কারেন্সি। মুদ্রা যেমন তাৎক্ষণিকভাবে হাতবদল করা যায়, তেমনই স্বর্ণও। রেমিট্যান্সের বদলে দেশে স্বর্ণ আসছে-এ অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার। যদি রেমিট্যান্সের বদলে স্বর্ণ আসে এবং রেমিট্যান্স কমার এটি অন্যতম কারণ হয় তবে অবশ্যই নীতিমালা পরিবর্তন করতে হবে। কেননা নীতিমালার আওতায় বৈধভাবে স্বর্ণ এনে যদি বেশি মুনাফা করা যায় তবে প্রবাসীরা সেদিকেই যাবে। ফলে বিষয়টি নিয়ে এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি।

গত ১ জুলাই থেকে এভাবে স্বর্ণ আনার নিয়ম চালু হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বভাবিক হলে গত নভেম্বর থেকে বিমান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এরপরই বিদেশ থেকে প্রবাসীরা বা বিদেশ থেকে আসার সময় বাংলাদেশিরা ২০ ভরি করে স্বর্ণের বার আনতে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে একটি সিন্ডিকেট।তারা স্বর্ণ আনার কাজে প্রবাসী ও বিদেশ থেকে আগত বাংলাদেশিদের কাজে লাগাচ্ছে। ওই গ্রুপের অনেকে প্রতি মাসে একাধিকবার বিদেশ যাচ্ছে এবং প্রবাসীদের কেনা স্বর্ণ দেশে নিয়ে আসছেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খোঁজ নিয়ে দেখেছে, যারা স্বর্ণ আনছে তাদের পারিবারিক অবস্থা মোটেও ভালো না। এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তারা স্বর্ণ আনছে কেন?সূত্র জানায়, যারা স্বর্ণ আনছে, তারা ক্যারিয়ার গ্রুপ হিসাবে কাজ করছে। বিনিময়ে ওই সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ভালো কমিশন পাচ্ছে। আরেকটি গ্রুপ বিদেশ থেকে স্বর্ণ এনে দেশে বিক্রি করে দিচ্ছে।অভিযোগ আছে-বৈধ পথের পাশাপাশি অবৈধভাবেও প্রতিমাসে সমপরিমাণ স্বর্ণ দেশে আসছে। কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, প্রতিমাসে ৫০ থেকে ৬০ কেজি স্বর্ণ আটক করা সম্ভব হলেও বিশাল অংশ থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের অধিকাংশই স্বর্ণ চোরাকারবারি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অবৈধভাবে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ দেশে আসছে।অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনতে একটি সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি হয়েছে। যেসব দেশ থেকে স্বর্ণ আসছে তারা ওইসব দেশে কাজ করছেন। চক্রটি স্থানীয় প্রবাসীদের মধ্যে প্রচার চালিয়ে বাড়তি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণ নিয়ে আসছে। এর বিপরীতে প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে ওই দেশেই স্বর্ণের দেনা শোধ করছে। দেশে আসার পর বা বিদেশে থাকতেই দেশে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে রেমিট্যান্সের সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে দিচ্ছে।

কাস্টমসের অপর একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩০০ থেকে ৪০০ যাত্রী ঘোষণা দিয়ে স্বর্ণ আনছেন। জনপ্রতি ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণ আনছেন। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৭১ থেকে ১০০ কেজি স্বর্ণ দেশে আসছে। এর দাম প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে সিলেট ও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েও এ প্রক্রিয়ায় স্বর্ণ আসছে।অথচ এই নিয়ম চালুর আগে বৈধ পথে স্বর্ণ আনার কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে স্বর্ণ যেটি আসত, এর পুরোটাই চোরাচালানের মাধ্যমে। এদিকে স্বর্ণ নীতিমালা অনুযায়ী, বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনটি কোম্পানি এলসি খুলে বৈধ পথে খুব সামান্য স্বর্ণ আমদানি করেছে।বাকিরা স্বর্ণ আমদানি করেনি। অথচ দেশের জুয়েলারির দোকানগুলোয় স্বর্ণে ভরা। এসব আসছে ব্যাগেজ রুল বা চোরাই পথে। স্বর্ণ আমদানির নীতিমালা অনুযায়ী, দেশে বছরে সর্বনিম্ন ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ১৮ থেকে ৩৬ টন স্বর্ণ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো হয়।আগে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে স্বর্ণ এলেও এখন ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো থেকেও আসছে। কাস্টমসের এক কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে লন্ডন থেকে একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণ নিয়ে আসার পর গত মঙ্গলবারও তিনি স্বর্ণ নিয়ে এসেছেন। কুমিল্লার একজন প্রবাসী দুবাই থেকে আসার সময় তার ব্যাগেজ বদলে যায়। তার হাতে থাকা ব্যাগে পাওয়া যায় স্বর্ণ। পরে তাকে গ্রেফতার করে থানায় পাঠানো হয়। পরে তদন্তে জানা যায়, একটি চক্র তার ব্যাগ বদল করে একই ধরনের স্বর্ণভর্তি একটি ব্যাগ তার হাতে ধরিয়ে দেয়। পুলিশ আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে।এদিকে যেসব দেশ থেকে স্বর্ণ আসছে, ওইসব দেশ থেকেই রেমিট্যান্স বেশি হারে কমেছে। দেশের মোট রেমিট্যান্সের ৫৩ শতাংশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আসছে ১৪ শতাংশ, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোয় ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৭ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে ৮ শতাংশ রেমিট্যান্স আসছে।গত অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্সে সবচেয়ে বেশি কমেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ২৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৪০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, কাতার থেকে ৫০ দশমিক ৭১ শতাংশ, কুয়েত থেকে ১৬ শতাংশ। এসব দেশ থেকেই বেশি স্বর্ণ আসছে। একই সঙ্গে সিঙ্গাপুর থেকে ৪৩ শতাংশ, মালয়েশিয়া থেকে ৫৭ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে। ওই দুটি দেশ থেকেও স্বর্ণ আনার ঘটনা ধরা পড়েছে।বিদেশে ব্যাংলাদেশের বড় বড় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শাখা বা এক্সচেঞ্জ হাউজ রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন। কিন্তু ছয় মাস ধরে প্রবাসীরা এগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাচ্ছেন কম। তারা অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছেন, প্রবাসীরা এখন ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডি বা স্বর্ণের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। এ বিষয়টি স্থানীয় ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে দেশের প্রধান কার্যালয়কে জানানো হয়েছে। ব্যাংকগুলো বিষয়টি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে। এ প্রবণতা কীভাবে বন্ধ করা যায়, সেটি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখন ব্যাগেজ রুলের নিয়মকানুন পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী বাজেটে এ ব্যাপারে ঘোষণা আসতে পারে।

Top
%d bloggers like this: