অবসরে গিয়ে তারা সেই প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছেন - Alokitobarta
আজ : রবিবার, ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদঃ
জুজুৎসুর নিউটনের যৌন নিপীড়নের ভয়ংকর তথ্য লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে বিদ্যুৎ খাতকে বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে তৃতীয় শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী ইসরাইল ও ফিলিস্তিনে তুমুল লড়াই চলছে যুক্ত হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের ২৫৭টি নতুন উন্নয়ন প্রকল্প কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে রিজার্ভের অঙ্ক ২৩ বিলিয়নের বেশি এনআইডির মতো গোপনীয় তথ্য বিক্রি স্পর্শকাতর তথ্য বিক্রি করেন র‌্যাব-এটিইউর দুই কর্মকর্তা সরকারের ৩৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর ৪৪৮ কোটি টাকা অচিরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আসর বসবে বরিশাল স্টেডিয়ামে পবিত্র হজ ১৬ জুন অনুষ্ঠিত হতে পারে

অবসরে গিয়ে তারা সেই প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছেন


মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন:ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ) প্রকল্পে স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সফটওয়্যার কেনার কাজ পাইয়ে দিতে প্রকল্পে দায়িত্বরত অবস্থায় যেসব কর্মকর্তা পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, অবসরে গিয়ে তারা সেই প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছেন। এখন ওই কর্মকর্তারাই আবার প্রভাব খাটিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানকে হার্ডওয়্যার (কম্পিউটার সামগ্রী) কেনার কাজ পাইয়ে দিতে তদবির শুরু করছেন। যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক প্রভাবশালী সদস্যের ‘সুনজর’ থাকায় প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ।অনুসন্ধানে জানা যায়, এনবিআর-এর সিস্টেম ম্যানেজার হিসাবে একসময় দায়িত্ব পালন করেন একেএম জাহিদ হোসেন। ওই সময় তাকে এনএসডব্লিউ প্রকল্পের সফটওয়্যার কেনার সর্বোচ্চ ব্যয় প্রাক্কলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কর্মকর্তার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ দর এবং সফটওয়্যারের সরবরাহের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত দর ছিল প্রায় কাছাকাছি। সফটওয়্যার কেনার টেন্ডারের শর্তে উল্লেখ ছিল-স্থানীয় কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় টেন্ডার ডকুমেন্টে উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু আইটি কর্মকর্তা অজ্ঞাত বা ভুলবশত স্থানীয় মুদ্রার বিষয়ে তার গোপনীয় নথিতে উল্লেখ করেননি। যেই প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার সরবরাহে কাজ পেয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানও ‘কাকতালীয়ভাবে’ দরপত্রে স্থানীয় মুদ্রা উল্লেখ করেনি। এ বিষয়ে জানতে পেরে টেন্ডারে অংশ নেওয়া বাকি প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো যোগসাজশের অভিযোগ এনে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করে। কিন্তু তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক জাকিয়া সুলতানার অদৃশ্য ইশারায় সেই অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে।

চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর পিআরএল শেষে তিনি এখন ওয়েব ফন্টেইনের পরামর্শক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এখন ওয়েব ফন্টেইনের হয়ে সফটওয়্যারের মডিউল ডেভেলপের পাশাপাশি এনবিআর-এর বর্তমান আইটি কর্মকর্তাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ স্থাপনের কাজ করছেন। জাহিদ হোসেনের পর এনবিআর-এর সিস্টেম ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ফজলুর রহমান। তিনিও এখন ওয়েব ফন্টেইনে দৈনিক চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পে থাকা অবস্থায় আমি ওয়েব ফন্টেইনকে চিনতাম না। তাছাড়া সফটওয়্যার কেনার কোনো ইভালুয়েশন কমিটিতেও আমি ছিলাম না। পিআরএলে থাকা অবস্থায় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের একটি প্রকল্পে কাজ শুরু করি। পরে ওয়েব ফন্টেইনের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আমি ওদের পরামর্শক হিসাবে কাজ করছি।’

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সদ্য অবসরে যাওয়া এনবিআর-এর সদস্য জাকিয়া সুলতানা দীর্ঘদিন এনএসডব্লিউ প্রকল্পের পরিচালক এবং পরবর্তী সময়ে এনবিআর-এর এনএসডব্লিউ শাখার সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রকল্প পরিচালক থাকা অবস্থায় পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে তিনি প্রকিউরমেন্ট গাইডলাইনের তোয়াক্কা না করে দরপত্রে একটি ব্র্যান্ড বা পণ্যের বাণিজ্যিক নাম উল্লেখ করে দেন। এ বিষয়ে তৎকালীন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে আপত্তি জানানো হলেও গোপনীয়তার অজুহাতে সফটওয়্যার কেনার টেন্ডার মূল্যায়ন কার্যক্রম থেকে তাদের কৌশলে বাইরে রাখা হয়। মূলত একক হস্তক্ষেপে দরপত্রের শর্ত পূরণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানকে সফটওয়্যার সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নিয়ে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠলে সেটি সামাল দেন এনবিআর-এর অপর প্রভাবশালী সদস্য।

অবসরে যাওয়ার পরপরই বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক হিসাবে এনএসডব্লিউ প্রকল্পে যুক্ত হওয়া, আপনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এক কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ সমর্থন করে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে জাকিয়া সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, ‘কার স্বার্থে রিপোর্ট করছেন জানি না। আপনি মনের মাধুরী মিশিয়ে যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন। আমি কিছুই বলব না।’

জানা যায়, এনএসডব্লিউ প্রকল্প বাস্তবায়নের ‘স্বার্থে’ জাকিয়া সুলতানাকে যে কোনো ফরমেটে ৬ মাস চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে জোর তদবির করেন প্রভাবশালী ওই সদস্য। এনবিআর চেয়ারম্যানের অনাগ্রহের কারণে সেটি আর হয়ে ওঠেনি। অবসরে যাওয়ার পর পিআরএলে থাকাবস্থায় জাকিয়া সুলতানা বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক হিসাবে কাজ করছেন। পরামর্শক হিসাবে এনএসডব্লিউ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। সর্বশেষ ২১ এপ্রিল ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেটের সভাকক্ষে কাস্টমস কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করলেও প্রভাবশালী ওই সদস্যের ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।

জনপ্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিআরএল ভোগরত অবস্থায় বেসরকারি চাকরি বা অন্য প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসাবে যোগদানে আইনত বাধা নেই। তবে একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যেহেতু পিআরএল ভোগরত অবস্থায় সরকারি চাকরিকালীনের মতোই বেতনভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন বা গ্রহণ করেন, সেহেতু এ সময় বেসরকারি চাকরি করা বা পরামর্শক হিসাবে কাজ করা অনৈতিক। এ ধরনের কর্মকর্তাদের নৈতিকতার মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন অস্বাভাবিক নয়।

গত বছরের ২৩ মার্চ এনএসডব্লিউ প্রকল্পের সফটওয়্যার কেনার অনিয়ম নিয়েএকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে দরপত্রের শর্ত ভঙ্গের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়। ওইদিন সফটওয়্যার কেনার প্রস্তাব সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত হলে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানান। কিন্তু এনবিআর চেয়ারম্যানের একক দৃঢ়তার কারণে সফটওয়্যার সরবরাহের কাজ বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়।

এনবিআরসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনবিআর চেয়ারম্যানের সততা ও সুনামকে পুঁজি করে কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আইটি উইংয়ের কেনাকাটার নামে শতকোটি টাকা লোপাট করছেন। এই সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের কমিশন নিচ্ছে সরবরাহকারীদের কাছ থেকে। যেমন এনএসডব্লিউ প্রকল্পের সফটওয়্যার কেনার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির সদস্যদের আপত্তি সত্ত্বেও শুধু এনবিআর চেয়ারম্যানের দৃঢ় অবস্থানের কারণে ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন হয়।

এ বিষয়ে এনএসডব্লিউ প্রকল্পের পরিচালক এবিএম শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, জাকিয়া ম্যাডাম বিশ্বব্যাংকে স্বল্পমেয়াদি পরামর্শক হিসাবে এনএসডব্লিউ প্রকল্পের কাজ দেখভাল করছেন। প্রকল্পের কাজে প্রভাব বিস্তার করছেন না, সব কাজ স্বাভাবিকভাবেই এগোচ্ছে।

প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে উন্নতি করার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ) প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৫৮৫ কোটি টাকা। দুই দফা মেয়াদ ও ২৪ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৬০৯ কোটি টাকা করা হয়। এ প্রকল্পের মূল্য উদ্দেশ্য ছিল আমদানি-রপ্তানি আবেদন গ্রহণ, প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিকারকদের সেবা সহজ করার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে খরচ ও সময় সাশ্রয় এবং পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস করা। প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে সফটওয়্যার কেনায় ২১৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে হার্ডওয়্যার (ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার) কেনা, পরামর্শক ফি, বিদেশে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের কথা রয়েছে।

Top
%d bloggers like this: