তিন মাস ধরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঢেউ ঊর্ধ্বমুখী - Alokitobarta
আজ : শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তিন মাস ধরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঢেউ ঊর্ধ্বমুখী


মো.মুরাদ হোসেন : তিন মাস ধরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঢেউ ঊর্ধ্বমুখী। চলতি বছরের জুলাই থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল পর্যন্ত দুই মাস ২৪ দিনে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩১৬ জন। এ সময় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৩ হাজার ৯১৭ জন। মৃত্যু এবং আক্রান্তের এই পরিসংখ্যান পিরামিড আকৃতিতে ওপরের দিকেই মাথা তুলছে। কবে এই গতি নিম্নমুখী হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৬ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা গেলেন ৯০৯ জন। এছাড়া একদিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩০০৮ জন। এ বছর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭২৫ জন।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এডিস মশা নির্মূলে কার্যকর ও স্থায়ী কোনো সমাধান মিলছে না। অপরদিকে জলবায়ু ও তাপমাত্রার ওঠানামার কারণেও ডেঙ্গু জায়গা করে নিয়েছে। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষকাল হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু এখন চলছে আশ্বিন মাস। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অসময়েও ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে যত্রতত্র জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বংশ বিস্তার বেড়েই চলেছে। সব মিলিয়ে কোনোভাবেই ডেঙ্গুর লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না।

অতিক্ষুদ্র এই মশার কামড় এতটাই বিপজ্জনক যে, আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসাসহ সেরে ওঠাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। কপাল মন্দ হলে মৃত্যু নিশ্চিত। গত কয়েক মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর চিত্র এমন বার্তাই দিচ্ছে। হাসপাতালে ঠাঁই মিলছে না রোগীর। ডেঙ্গু রোগীর চাপে শয্যার বাইরে বারান্দা, করিডরে রোগীদের বিছানা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর প্রধান চিকিৎসায় তরল ব্যবস্থাপনার অংশ হিসাবে স্যালাইন অতীব প্রয়োজনীয়। কিন্তু অনেক হাসপাতালে স্যালাইন সংকট রয়েছে।এদিকে রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ বছর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় জুলাই, আগস্ট এবং চলতি সেপ্টেম্বর মাসে। জুলাই মাসে রোগী ছিল ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন, মৃত্যু হয়েছিল ২০৪ জনের। আগস্টে তা বেড়ে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন হয়। মৃত্যু হয়েছিল ৩৪২ জনের। ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭২৫ জন এবং মারা গেছেন ৯০৯ জন।

এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু আউটব্রেক হয়েছিল। সেই বছর মোট আক্রান্ত ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। কিন্তু এই বছর শেষ হওয়ার আগেই যে সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তা ২০১৯ সালের তুলনায় অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, এবার সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকায়। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি রোগী চট্টগ্রাম এবং বরিশালে। ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী এসব জেলায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর জেলা এবং বরিশাল বিভাগের বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায় বেশি আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে। চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সব জেলা ও উপজেলা হাসপাতালসহ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও একই প্রটোকল এবং গাইডলাইন অনুসরণ করে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকদের ডেঙ্গু চিকিৎসা এবং পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।স্যালাইন সংকট প্রসঙ্গে অধিদপ্তরের এই পরিচালক বলেন, সব জায়গাতেই ডেঙ্গু পরীক্ষার পর্যাপ্ত এনএস-১ কিট মজুদ রয়েছে। ডেঙ্গু পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন সেটি হলো আইভি ফ্লুইড স্যালাইন। এই স্যালাইন নিয়ে সাময়িক একটা সমস্যা হয়েছিল। জরুরিভাবে ৩ লাখ প্যাক স্যালাইন আমদানি করেছি। ইতোমধ্যে ৪৪ হাজার প্যাক স্যালাইন আমরা হাতে পেয়েছি। এ মুহূর্তে স্যালাইনের সমস্যা হচ্ছে না। আরও কিছু স্যালাইন আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। সবমিলিয়ে স্যালাইন নিয়ে আর কোনো সংকটের মুখোমুখি হতে হবে না।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে সামগ্রিক অবস্থা পূর্ণ বিবেচনায় নিতে হবে। সায়েন্টিফিক পদ্ধতি ছাড়া মশার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য কীটনাশক নির্বাচন, প্রয়োগ পদ্ধতি ও প্রয়োগকর্মীর প্রশিক্ষণ যথাযথভাবে দিতে হবে। একই সঙ্গে সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনার ওপর সর্বাত্মক জোর দিতে হবে। পরিবেশ-মশা-ডেঙ্গু ভাইরাস-মানুষের আন্তঃক্রিয়ার যথার্থ ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। মশার প্রজননস্থলের সঠিকতা নিরূপণ ও তার উৎপাদন সক্ষমতার পরিমিতি যতক্ষণ পর্যন্ত নির্দিষ্টকরণ ও সেই অনুসারে তা ধ্বংস সম্ভব না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মশার ঘনত্ব কমানো সম্ভব নয়। আর এই কাজগুলো করতে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। সর্বোপরি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। মশা কমলে আক্রান্ত মৃত্যু কমবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার উপপরিচালক ডা. দাউদ আদনান বলেন, পরিবেশ নির্ভর করে জলবায়ুর ওপর। যেটি মানুষ এবং প্রকৃতি উভয়ের মাধ্যমইে ভালো ও খারাপ হতে পারে। জলবায়ু পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেললে সেখানে মানুষের মতো ভেক্টর (এডিস মশাসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ) টিকে থাকা বা খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে শেখে। বিশেষ করে পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়লে মশার ডিমপাড়া, প্রজনন ক্ষমতা ও বংশ বিস্তার বেশি হয়। অন্যান্য ভেক্টরের মতো এডিস মশাও দ্রুত সময়ে পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওঠে। মানুষকে কামড়ানোর পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন মশাবাহিত রোগও বাড়ে। ডেঙ্গুর যে প্রাদুর্ভাব চলছে তা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এডিস মশা বৃদ্ধি ও তার কামড়ের ফলেই হচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে হলে সবার আগে এডিস মশা কমাতে হবে।

Top
%d bloggers like this: