বরিশালে দুর্নীতিবাজ কর্মচারীকে রক্ষা করতে সিভিল সার্জনের গোপন বৈঠক!
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্তকারীদল বরিশাল পৌছানোর একদিন আগে দুর্নীতি ফাঁস না করতে অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুই দফা স্বীকারোক্তি নেওয়া হয় \ গোপন বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিলো সেলিমকে বাঁচাতে না পারলে সিভিল সার্জন নিজেও ফেঁসে যেতে পারেন
মাসুদ রানা: দেখেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে এখন সব জায়গায় তদন্ত চলছে। আমাদের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সেলিম হোসেনের দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে তদন্ত দল আসছে। আমার বিরুদ্ধেও তদন্ত হতে পারে। এমনকি আপনাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত হতে পারে। তাই আমি চাই আপনারা তদন্তকারীদের কাছে সেলিমের দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে মুখ খোলবেন না। ওর পক্ষে মতামত দেবেন। আসল বিষয়গুলো এড়িয়ে যাবেন তা না হলে আমাদের সবার ক্ষতি হয়ে যাবে। আপনাদের আরো একদিন শপথ পড়িয়েছি, আজও এজন্য শপথ পড়ালাম।’ বরিশাল সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন গোপন বৈঠক ডেকে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় তার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ কথাগুলো বলেন।
এদিকে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সেলিম দীর্ঘদিনের দোষত্রুটির জন্য বৈঠকে উপস্থিত তার সহকর্মীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। গোপন ওই বৈঠকের একটি রেকডিং প্রতিদিনের সংবাদের এ প্রতিবেদকের কাছে আছে। এ ঘটনার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশাল সিভিল সার্জন অফিসের সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম কম্পিউটার অপারেটর সেলিম হোসেনের সরকারি অর্থ আত্মসাৎ এবং বিভিন্ন সময়ে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিকদের কাছ থেকে মাসোহারা গ্রহণের অভিযোগ তদন্তের জন্য গত মঙ্গলবার ঢাকা স¦াস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (শৃঙ্খলা-২) ডা. হেলিশ রঞ্জন সরকার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাজেমান আলী বরিশাল সিভিল সার্জন অফিসে আসেন। তদন্তকারী দল দুর্নীতির কোনো তথ্য যাতে না পায় সেজন্য সিভিল সার্জন ও সেলিমের যোগসাজশে আগের দিন সন্ধ্যায় অফিসের কর্মকর্তা গোপন বৈঠকে বসেন। সেখানে সিভিল সার্জন অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন, প্রধান সহকারী কর্মকর্তা জলিলুর রহমান, অফিস সহকারী জহিরুল হক খান, নজরুল, সিদ্দিক, রফিকুল ইসলাম ও ইপিআই টেকনেশিয়ান লোকমান হোসেন ও অভিযুক্ত সেলিমসহ ১০-১২ জন উপস্থিত ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সেলিমের দুর্নীতি ঢাকতে না পারলে সিভিল সার্জন নিজেও রক্ষা পাবেন না। এমনকি আরো কয়েকজন কর্মকর্তা ফেঁসে যেতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিভিল সার্জন অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, সেলিমের অত্যাচারে যেমনি অফিসে টিকে থাকা দায় তেমনি তার দুর্নীতি আর অনিয়মে সিভিল সার্জন অফিস কলঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ওই অফিসের অপর এক কর্মচারী জানান, স্টেনো সেলিম ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে। ডাক্তার ও নার্স না থাকলেও বরিশালের উপজেলাগুলোতে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক চালু করার মৌখিক অনুমতি দেন এবং তাদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেন। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বা ক্লিনিকে কোনো অভিযান হয় না। সিভিল সার্জন সেলিমের মাধ্যমে এ মাসোয়ারার ভাগ নেন বলে অভিযোগ আছে। ওই কর্মচারী বলেন, গৌরনদী শিকদার ক্লিনিক, শারমিন ক্লিনিক, মৌরী ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং সেখানকার সুইজ হাসপাতাল থেকে মাসোহারা নেওয়া হতো। এছাড়া, চাকরিপ্রার্থীদের ডোপ টেস্টের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের দুর্নীতি করা হয়। বরিশালের একাধিক প্রতিষ্ঠান ডোপ টেস্ট করলে সিটি এলাকার ল্যাব পয়েন্ট নামে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রভাবিত করে সেখানে পাঠানো হয়। প্রতি ডোপ টেস্টে ২৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। দুর্নীতিবাজ সেলিম ও সিভিল সার্জন প্রতি ডোপ টেস্টে কমিশন নেন বলে রক্ত পরীক্ষায় বেশি মূল্য রাখা হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। অথচ ঢাকায় বা এখানকার অন্য ডায়াগনস্টিকগুলোতে ডোপ টেস্ট মাত্র ১২০০ টাকা। অন্যদিকে দেশের বাইরে পড়ালেখা করতে যাওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সিভিল সার্জনের সনদ প্রয়োজন হয়। কম্পিউটার অপারেটর সেলিম মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সিভিল সার্জনের কাছ থেকে সনদ এনে দেন। এর বাইরেও ডাক্তারদের বদলির বিষয় দেখেন সেলিম, এখানেও হয় বিরাট ঘুষ বাণিজ্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক মালিকদের সঙ্গে টাকার লেনদেন হয় সিভিল সার্জন অফিস লাগোয়া লঞ্চঘাটের সামনে ইসলামিয়া খাবার হোটেলে, মাধ্যম এই কম্পিউটার অপারেটর সেলিম।
স¦াস্থ্য অধিদফতরের একটি আদেশে বরিশাল সিভিল সার্জন অফিসের সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর সেলিম হোসেনকে রংপুরের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ে বদলি করা হয় মাস খানেক আগে। সেখানে বলা হয়েছে, আদেশ জারির ৭ কার্যদিবসের মধ্যে যোগদান না করলে ৮ম কর্ম দিবসে অব্যাহতি বলে গণ্য হবে। অথচ অদৃশ্য ক্ষমতা বলে বরিশাল অফিসে এখনো বহাল আছেন সেলিম। সিভিল সার্জন মনোয়ার হোসেনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বদলির আদেশটি এখনো কার্যকর হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদন্ত টিম বরিশাল আসার আগের দিন গোপন বৈঠক ও দুর্নীতির বিষয়ে সেলিম জানান, আমি জ¦রে ভুগছি, বাসায় আছি। একই বিষয়ে বরিশাল সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন জানান, আমরা নিজেদের বিষয় নিয়ে বৈঠক করতেই পারি। এটা একান্তই আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে আপনাদের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখি না। জানা গেছে, সিভিল সার্জন অফিসে তদন্তকারীরা ঢাকা থেকে এসে সবাইকে ডাকেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ডাকে কাছে গেলে তাদেকে হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়। এ হুমকি দেন সেলিম ও একই অফিসে চাকরি করে তার ভাগ্নে জহিরুল। এ বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (শৃঙ্খলা-২) ডা. হেলিশ রঞ্জন সরকার জানান, বরিশাল সিভিল সার্জনের দুর্নীতির কথা অনেক আগ থেকেই শুনে আসছি। আপনারা সাংবাদিক ও সচেতন মহল সচেষ্ট হন। তাহলে এখানকার দুর্নীতি বন্ধ হবে।