আগুন, বিস্ফোরণসহ নাশকতার পেছনে আওয়ামী লীগ - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আগুন, বিস্ফোরণসহ নাশকতার পেছনে আওয়ামী লীগ


জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক,আলোকিত বার্তা:পতিত আওয়ামী লীগের সব ধরনের অপতৎপরতা আগুন, বিস্ফোরণসহ নাশকতার।রাজধানীতে একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণ,তিনটি বাসে অগ্নিসংযোগ এবং দিনের আলোয় গুলি করে হত্যার ঘটনায় এক ধরনের ভয় ও অজানা শঙ্কা পেয়ে বসেছে রাজধানীবাসীকে এর পেছনে আওয়ামী লীগ ।রাজনৈতিক উত্তেজনা ও নানা গুজবের দোলাচলে অস্থির হয়ে উঠেছে নগরজীবন। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি-পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।সোমবার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এসব ঘটনা ঘটে।জানা গেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির রায়ের তারিখ ঘোষণা হবে আগামী ১৩ নভেম্বর। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর এই বহুল আলোচিত রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা জল্পনা, উসকানি ও গুজব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে ওইদিন (১৩ নভেম্বর) ‘ঢাকা লকডাউন’-এর আহ্বানসংক্রান্ত পোস্ট ও ভিডিও বার্তা। পতিত আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা ছিল সোমবার থেকে বুধবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার আশপাশসহ ঢাকায় আওয়ামী লীগের স্লোগান সংবলিত এক লাখ বেলুন ওড়ানোর। এমন তথ্য জানতে পেরে গোয়েন্দারা সন্দেহভাজন ২৫ জনকে গ্রেফতার করেছেন।

অন্যদিকে সব ধরনের অপতৎপরতা রুখতে পুলিশকে সক্রিয় থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ডিএমপির পক্ষ থেকে।এছাড়া প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন এলাকাসহ অন্তত ১১টি স্থানে সভা-সমাবেশ এবং দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।জামায়াতসহ ৮ দলের আজকের (মঙ্গলবার) সমাবেশেও তীক্ষ্ণ নজরদারি রাখছেন গোয়েন্দারা। যাতে ওই সমাবেশের জনস্রোতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ঢুকে কোন ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করতে না পারে।

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন বলেন, পতিত আওয়ামী লীগের সব ধরনের অপতৎপরতা রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের পাশাপাশি সব ধরনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তিনি বলেন, জামায়াতের সমাবেশের আড়ালে যাতে কেউ ছদ্মবেশে ঢুকে কোনো অপতৎপরতা না চালাতে পারে সে বিষয়ে জামায়াতের নেতাদেরও জানানো হয়েছে। যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে, তার দায় ওই দলটিকে নিতে হবে। এছাড়া ওই সমাবেশকে ঘিরে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত থাকবে।

জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। যে কোনো ধরনের নাশকতা কঠোর হাতে দমন করতে হবে। আগুন, বিস্ফোরণের বিষয়ে তিনি বলেন, আগুন, বিস্ফোরণসহ নাশকতার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ থাকতেই পারে। যে কোনো ধরনের অপতৎপরতা রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতার বিকল্প নেই।

চার স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ : সোমবার ভোররাতে মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে এলাকা। পরে পুলিশ জানায়, সেটি ছিল ককটেল বিস্ফোরণ। মিরপুর মডেল থানার ওসি সাজ্জাদ রোমান বলেন, ভোরে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বিস্ফোরণ ঘটায়। কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ চলছে।এর কিছুক্ষণ পর মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তারের প্রতিষ্ঠান ‘শস্য প্রবর্তনা’র সামনে আরও দুটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, মোটরসাইকেলে আসা দুই ব্যক্তি গেটের ভেতরে ও রাস্তায় ককটেল নিক্ষেপ করে দ্রুত পালিয়ে যায়। ওইদিন সকালেই ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মাইডাস সেন্টারের সামনে ঘটে আরেকটি ককটেল বিস্ফোরণ। ধানমন্ডি থানার ওসি জানান, ঘটনাস্থল থেকে ব্যাটারি, তার ও বিস্ফোরকের টুকরো উদ্ধার করা হয়েছে। তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে, তিনটি ঘটনার পেছনে একই নাশকতাকারী গ্রুপ জড়িত।এছাড়া আগারগাঁও এলাকায় বাংলাদেশ বেতার ভবনের সামনে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। পুলিশ জানায়, বেতার ভবনের প্রধান ফটকের সামনে কে বা কারা একটি ককটেল ছুড়ে মারলে সেটি বিস্ফোরিত হয়। তবে কেউ হতাহত হননি।

তিন বাসে অগ্নিসংযোগ : সোমবার রাত সাড়ে ৭টার দিকে ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়। এর আগে ভোরে আধা ঘণ্টার ব্যবধানে বাড্ডা ও শাহজাদপুরে দুটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা রাশেদ বিন খালেদ জানান, ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে শাহজাদপুরে ভিক্টর পরিবহণে আগুন লাগে। কিছুক্ষণ পর বাড্ডায় আকাশ পরিবহণের বাসেও আগুনের ঘটনা ঘটে। আমরা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। এসব ঘটনায় পেট্রোল বা দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছিল কি না-তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আকাশ পরিবহণে আগুনের ঘটনায় বাসের মালিক বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। এছাড়া সোমবার বেলা ১১টার দিকে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেলের ফটকে গুলি করে হত্যা করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে।

এছাড়া গত ৭ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে রমনার সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল চার্চে দুটি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এর একটি বিস্ফোরিত হয়, অপরটি বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল উদ্ধার করে। একই রাতে মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফ স্কুলের ভেতরেও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, বাইরে থেকে ভেতরে ছুড়ে মারা হয় ককটেলটি। রমনার সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল চার্চে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগে আতঙ্কে নগরবাসী। সামাজিক মাধ্যমে ‘রাজধানী জ্বলছে’, ‘আবার ফিরছে ২০১৩’র সহিংসতা’-এমন বিভ্রান্তিকর পোস্টে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুলছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, সন্ধ্যার পর থেকেই অচেনা এক ভয় কাজ করছে মনে। বাড্ডার বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, ফেসবুক, ইউটিউবে যেভাবে খবর ছড়ানো হচ্ছে, এসব শুনে এখন বাইরে যেতেই ভয় লাগে। এদিকে অফিসগামীদের অনেকে বলছেন, সকাল-বিকাল রাস্তায় পুলিশের টহল দেখে বোঝা যায়, কিছু একটা ঘটতে পারে।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এসব গুজব নজরদারিতে রয়েছে এবং উৎস শনাক্তে কাজ করছে ডিবির সাইবার ইউনিট। তিনি জানান, রাজধানীতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পেছনে পতিত আওয়ামী লীগের একটি সংগঠিত চক্র কাজ করছে। সব ঘটনার সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ চলছে। একই ধরনের মোটরসাইকেল ও মুখোশ পরা দুই ব্যক্তির ছবি পাওয়া গেছে বিভিন্ন স্থানের ফুটেজে। সিআইডি ও বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিটের ফরেনসিক টিম উদ্ধার হওয়া বিস্ফোরক পরীক্ষা করছে। প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে, এগুলো হ্যান্ডমেড ককটেল টাইপের এক্সপ্লোসিভ, যা রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

পুলিশ জানায়, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্লকরেইড ও টহল জোরদার করা হয়েছে। মসজিদ, গির্জা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবনগুলোতে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। গত ১০ মাসে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ৩ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রোববার রাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত ঝটিকা মিছিল ও নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের আরও ৩৪ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান জানান, নাশকতামূলক অপতৎপরতা রুখতে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের। নগরবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে সব থানায় টহল ও চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে বাড়তি ফোর্স।

জানতে চাইলে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক বলেন, বাসে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ ও খুনের ঘটনা মানুষকে উদ্বিগ্ন করবে এটা স্বাভাবিক। যারা এসব অপকর্ম করছে, তাদের খুব বেশি শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে-সেই বিষয়টিও আমরা দেখছি না। তিনি বলেন, অপরাধীরা যদি অপরাধ করে পার পেয়ে যেতে পারে, তারা যদি সংঘাত সৃষ্টি করে নিজেদের আইনের বাইরে রাখতে পারে, সেখানে তারা আরও বেশি অপরাধ করবে। তারা টাকা নিয়ে কারও হয়ে চুক্তিবদ্ধ অপরাধ করবে। তাদের উদ্দেশ্য মানুষের মনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা। তিনি বলেন, ১৩ নভেম্বরকে নিয়ে আওয়ামী লীগের হুঙ্কার এবং সংঘাত-সহিংসতার অভিযোগ রয়েছেই। এই সংঘাত-সহিংসতার ক্ষেত্রে আগুন সন্ত্রাস এবং ককটেল বিস্ফোরণ আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনেক পুরোনো। যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল এবং নিজেদের বড় মনে করে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই এই ধরনের সংঘাত-সহিংসতার অভিযোগ আছে।

বিভিন্ন সময়ে এসবের প্রমাণও আছে। এটি কিন্তু একটা অশনিসংকেত। সন্ত্রাস অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মানুষের মাঝে সব সময় একটা আতঙ্ক বিরাজ করবে। গণপরিবহণে উঠলে সব সময় মানুষকে আগুন আতঙ্ক বিচলিত করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জোরালোভাবে মোকাবিলা করতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি পুলিশ এককভাবে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। সশস্ত্র বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সহযোগিতায় এসব মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য সব সক্রিয় রাজনৈতিক দলের পরিপূর্ণ সহযোগিতা লাগবে। এছাড়া এই মুহূর্তে যে রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় আছে, তাদের কোনো নেতাকর্মী এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।

Top