মনোনয়ন পেয়েছেন ৬ জন,বহিষ্কৃতদের ফেরাচ্ছে বিএনপি
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া: তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে ছিল দখল,চাঁদাবাজি কিংবা আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ।কিন্তু আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে দলের।৫ আগস্টের পর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে একে একে পাঁচ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছিল বিএনপি।ইতোমধ্যে বহিষ্কৃত ছয় নেতাকে ফিরিয়ে এনে মনোনয়নও দেওয়া হয়েছে।তাই নির্বাচনের তিন মাস আগেই দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদ মিটিয়ে নির্বাচনি মাঠ প্রস্তুত করতে চাইছে বিএনপি।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কঠিন নির্বাচনি লড়াই মোকাবিলা করে বিজয় নিশ্চিতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছে দলটি। এর অংশ হিসাবে বহিষ্কৃত হওয়া অন্তত ৮০ জন তৃণমূল নেতাকে (দল ও অঙ্গ-সহযোগী) ধাপে ধাপে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের কয়েকজন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নও পেয়েছেন। সর্বশেষ রোববার একসঙ্গে ৪০ নেতার পদ ফিরিয়ে দিয়েছে দলটি।
যদিও আসন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ঘিরে শৃঙ্খলাবিরোধী ইস্যুতে আবার কঠোর হচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড।প্রাথমিক পর্যায়ে ২৩৭টি আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করলেও তা পর্যবেক্ষণে রাখছে দলটি।বিএনপির সাংগঠনিক টিম এসব এলাকার নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করছে। শৃঙ্খলাবিরোধীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছে হাইকমান্ড। সে ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি অন্তত ৫০ জন নেতাকর্মীকে (দল ও অঙ্গ-সহযোগী) বহিষ্কার করেছে বিএনপি।দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে এবং তৃণমূলে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে এই পুনর্বহাল প্রক্রিয়া চলছে। বিএনপি মনে করছে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। তাই পুরোনো কর্মীদের ফেরানো কেবল সাংগঠনিক নয়, এটি দলের কৌশলগত সিদ্ধান্তও। শিগগিরই আরও অনেকের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হতে পারে।
দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিগত সময়ে নানা অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছিল, তাদের বেশির ভাগই ভুল স্বীকার করেছেন। ভবিষ্যতে দলের প্রতি আনুগত্য থাকার অঙ্গীকার করে পদ ফিরে পেতে অনেকে আবেদনও করেছেন। এগুলো যাচাই-বাছাই করে কারও কারও বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেওয়া হচ্ছে। অতীত ত্যাগ ও অবদান বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। বিএনপি মনে করছে, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভেদ নিরসন করে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের জয় নিশ্চিত করতে পারে।বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে আমরা বহিষ্কার করেছিলাম। তারা সবাই দলের ত্যাগী কর্মী। জেল-জুলুম, অত্যাচার সহ্য করেছে। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য দলের কাছে ক্ষমা চেয়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করার পর এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন যেসব বহিষ্কার হচ্ছে-সেগুলো দলীয় শৃঙ্খলা না মানার জন্য। আসনপ্রতি বিএনপির নমিনেশন একজন পাবে। বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবাইকে (মনোনয়নপ্রত্যাশী) ডেকে বলেছিল, সবাই যোগ্য। তবে নমিনেশন একজন পাবেন। যিনি বেশি ভোট টানতে পারবেন, তাকেই দেওয়া হবে। এর পরেও মশাল মিছিল, ভাঙচুরসহ শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে তারা তো আর দলের কর্মী থাকে না। সেজন্য আমরা দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। আমরা আগেই বলেছি, এটি প্রাথমিক মনোনয়ন। পরে পর্যালোচনা হতে পারে। এরপরও রাস্তা অবরোধ কিংবা বিশৃঙ্খলা করবে এটা হতে পারে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ’২৪ গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও তার অঙ্গসহযোগী সংগঠনের পাঁচ হাজারের বেশি নেতাকর্মী বহিষ্কার হয়েছে। কারও কারও পদ স্থগিত রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তৃণমূলের প্রায় ৮০ জন নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। তারা গণ-অভ্যুত্থানের আগে-পরে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
জানা গেছে, বিভিন্ন অভিযোগে বহিষ্কৃত হলেও বিএনপির এসব নেতা দল ছেড়ে যাননি। আবার কেউ কেউ বহিষ্কৃত থেকেও নানাভাবে দলীয় কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রেখেছেন। নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দলে ফেরানো হচ্ছে।
এদিকে গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে বিএনপি। দলীয় প্রার্থীর হাত সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করাসহ এলাকাভিত্তিক নির্বাচনি কাজে গতি আনতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। চলতি বছরের মধ্যেই এলাকাভিত্তিক বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফেরানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় এবং মাঠপর্যায়ে প্রভাবশালী নেতাদের আবেদন পর্যালোচনা করে শিগগিরই দলে ফিরিয়ে নেওয়া হতে পারে।
তৃণমূল নেতারা মনে করেন, নির্বাচন সামনে রেখে বহিষ্কৃত নেতারা দলে ফেরায় তৃণমূলে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। অনেকেই ইতোমধ্যে এলাকাভিত্তিক কাজ শুরু করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় নির্দেশনা মেনে নেতাকর্মীরা নির্বাচনি তৎপরতা চালাবে এমনটাই মনে করে বিএনপি। সম্প্রতি বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে এমন নেতাদেরও দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে রয়েছে-চট্টগ্রাম-১ আসনে নুরুল আমিন চেয়ারম্যান, ময়মনসিংহ-১১ আসনে ফকর উদ্দিন আহমেদ, পিরোজপুর-৩ আসনে রুহুল আমিন দুলাল, রংপুর-১ আসনে মোকাররম হোসেন সুজন, রংপুর-২ আসনে মোহাম্মদ আলী সরকার ও খুলনা-২ আসনে নজরুল ইসলাম মঞ্জু। এছাড়াও তিন মাসের জন্য স্থগিত হলেও কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন মো. ফজলুর রহমান। যদিও তার স্থগিতাদেশ উঠতে এখনো ১৫ দিন বাকি রয়েছে।
কুমিল্লা বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া বলেন, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়টি দলের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত। তবে নির্বাচন সামনে রেখে যারা বিশৃঙ্খলা করবে তাদের বিষয়ে দল কঠোর হচ্ছে। কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএনপি। এখন নতুন করে বহিষ্কার হলেও আগামী নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।
নির্বাচন ঘিরে কঠোর হচ্ছে বিএনপি : প্রাথমিকভাবে ২৩৭টি আসনে দলীয় একক প্রার্থী ঘোষণার পর বেশ কিছু এলাকায় সংঘর্ষ, অবরোধ এবং বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় একটি আসনে স্থগিত করাসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অন্তত ৫০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে সারা দেশে অন্তত ১৯টি আসনে প্রার্থিতা নিয়ে দলের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, অবরোধ, বিক্ষোভ এবং মিছিল হয়েছে। প্রার্থিতা বদল ও মনোনয়নপ্রত্যাশাকে ঘিরে এসব ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে বলে মনে করছেন নেতারা। অন্যদিকে ৬৩ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেনি বিএনপি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করার জন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সমর্থকরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, কিছু আসনের মনোনয়ন দেয়া প্রার্থীদের নিয়ে কেউ কেউ আপত্তি তুলছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের অভিযোগ আছে। সে কারণে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। দলের পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে কিছু আসনে প্রার্থী পরিবর্তন হতে পারে এমনটাও মনে করছেন তারা।