শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় হতে পারে নভেম্বরে - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় হতে পারে নভেম্বরে


মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এ মামলার রায়ের দিন কবে, জানা যাবে ১৩ নভেম্বর। হাসিনা সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়ে গৃহযুদ্ধ লাগানোর চেষ্টা করেছেন। এসব অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। তারা বলেছেন, আগামী প্রজন্মের জন্য এমন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যাতে খুনের রাজনীতি বন্ধ হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের খালাস প্রার্থনা করেছেন। আর ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, এই আদালত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।ওইদিন রায়ের তারিখ ধার্য করবেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বৃহস্পতিবার এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষে এ আদেশ দেন আদালত। আদালত বলেছেন, ওইদিন সংক্ষিপ্ত তারিখ দিয়ে রায়ের দিন ধার্য করা হবে। বিচারসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নভেম্বরেই এ মামলার রায় ঘোষণা করা হতে পারে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।এদিন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ৩৬ দিনে গুলি করে প্রায় দেড় হাজার নিরীহ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। আহত করা হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষকে। যাদের মধ্যে চোখ, হাত ও পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তার সহযোগীরা এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।

এ দিন মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এ মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করেন। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্যের জবাব দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনিও শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সর্বোচ্চ শাস্তি চান। এদিন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের খালাস প্রার্থনা করেন।১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। এর মধ্য দিয়ে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার বিচার শুরু হয়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১০৩ দিনে এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হলো। এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে মামুন নিজের দোষ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়েছেন। এ মামলায় ৫৪ জন সাক্ষ্য দেন।

সাহস থাকলে শেখ হাসিনা ন্যায়বিচারের মুখোমুখি হতেন : বৃহস্পতিবার অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সমাপনী বক্তব্য দেন। তিনি পবিত্র কুরআনের সুরা নিসাসহ দুটি সুরার আয়াতের রেফারেন্স টানেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রথমবার কোনো শাসক-শোষক বা ফ্যাসিস্টকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম, তিনি ন্যায়বিচারের সামনে আসবেন। ক্ষমতায় থাকতে তিনি আরেকজন রাজনৈতিক নেতাকে বলেছিলেন সাহস থাকলে বাংলাদেশের মাটিতে এসে বিচারের মুখোমুখি হোক। আমার বিশ্বাস ছিল এ কথাটা মন থেকে বলেছিলেন। এটা বিশ্বাস করে বলেছিলেন। কিন্তু দেখলাম তিনি মন থেকে বলেননি। তার যদি সাহস থাকত, তাহলে বাংলাদেশের মাটিতে এসে এই বিচারের মুখোমুখি হতেন। তিনি বলেন, আজ আমি ন্যায়বিচার প্রত্যক্ষ ও সাক্ষী হতে এসেছি। এ মামলায় সব ধরনের দালিলিক-মৌখিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছে প্রসিকিউশন পক্ষ। ভাগ্যিস আসামিরা বলেননি এ দেশে কোনো জুলাই রেভ্যুলেশন হয়নি, কেউ মারা যাননি কিংবা আহত হননি। অথচ বাংলাদেশে ১৪০০ মানুষ মারা গেলেন। এত বড় একটা জুলাই রেভ্যুলেশন হলো, হত্যাকাণ্ড হলো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টেট অ্যাপারেটাস (রাষ্ট্রযন্ত্র) ব্যবহার করে। একপর্যায়ে তিনি বলেন, বিচার যত কঠিনই হোক, যত বাধার প্রাচীর আসুক-সব বাধার প্রাচীর ভেঙে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা জাতি হিসাবে আগামী দিন এগোতে পারব না।

অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এই আসামিদের হাতে বাংলাদেশের অসংখ্য-অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তাদের হাতে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবে। পাঁচ বছরের শিশু মারা যাবে। ১০ বছরের আনাস মারা যাবে। পানি বিতরণ করা অবস্থায় মুগ্ধ মারা যাবে। বুক চিতিয়ে আবার রাজপথে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদরা মারা যাবেন। আমরা যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি তবে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসে একটি ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাবে। সে কারণেই আমরা মনে করি, এ বিচারে যা প্রমাণ করেছি, সেটা বিয়ন্ড অল রিজনেবল ডাউট (এ নিয়ে কোনো যুক্তিসংগত সন্দেহ নেই)। সবশেষ ট্রাইব্যুনালের কাছে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা প্রার্থনা করেন দেশের এই সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা। এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, কোন পক্ষ কী উপস্থাপন করল, কে কী বলল, তা বড় কথা নয়; ট্রাইব্যুনাল ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।

শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়ে গৃহযুদ্ধ লাগানোর চেষ্টা করেছেন : অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শেষ হলে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতের অনুমতি নিয়ে শেখ হাসিনার আইনজীবীর যুক্তিতর্কে দেওয়া বক্তব্যের জবাব দেন। শেখ হাসিনার আইনজীবী বলেছিলেন, ‘এই আইনে বিচার করা মানে আসামিকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে বলা, সাঁতার কাটো।’ তিনি বলেন, এ আইনটি (আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, ১৯৭৩) রোম স্ট্যাটিউটের সঙ্গে ‘কমপেটিবল’ করা হয়েছে। সংবিধান এই আইনকে ‘প্রটেকশন’ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আইনটির ১৯ ধারার কথা উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল। এছাড়া ভিডিও, অডিও যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এনটিএমসি, বিবিসি এবং আলজাজিরার সঠিকতা যাচাইয়ের কথা উল্লেখ করেন। তাজুল ইসলাম বলেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গন্ডগোল লাগানোর চেষ্টা করেছেন।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, যারা এখানে আসামি হয়েছেন, তাদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান) মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। এত বড় অপরাধ করেছেন, দুনিয়ার সবাই জানে এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তিনিও জানেন; কিন্তু কখনোই তার মধ্যে কোনো ধরনের অনুশোচনা পরিলক্ষিত হয়নি। উলটো তিনি যারা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তাদের হত্যা করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলছেন। তাদের লাশগুলো বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়ার কথা বলছেন। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের মধ্যে একটা সিভিল ওয়ার (গৃহযুদ্ধ) লাগানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী সেই পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। বাংলাদেশের জনগণ সেই পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। যারা পারপিট্রেটর (অপরাধী) ছিল, তাদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য তাদের অঙ্গীকারের প্রতি দৃঢ় আছেন। আদালতে তাদের নিয়ে এসেছেন। বিচারের প্রক্রিয়া স্মুথলি সামনে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো উসকানিতে কেউ পা দেয়নি।

পালিয়ে যাননি শেখ হাসিনা, যেতে বাধ্য হয়েছেন : স্টেট ডিফেন্স (আসামিপক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী) মো. আমির হোসেন বলেন, আজ লার্নেড যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেই প্রেক্ষাপটে আমি দুটি জবাব দিয়েছি। উনি বলতে চাইছেন যে আমার আসামি পালিয়ে গেছেন। আমি সেক্ষেত্রে বলেছি যে আমার আসামি পালিয়ে যাননি। তিনি এ দেশ থেকে যেতেই চাননি, তা বিভিন্ন পত্রপত্রিকাসহ প্রতিটি জায়গায় এসেছে। তিনি (শেখ হাসিনা) এ কথাও বলেছেন যে, আমাকে প্রয়োজনে এখানে মাটি দেন, হত্যা করেন, তবু আমি যাব না। কিন্তু প্রেক্ষাপট এমন দাঁড়িয়েছে, ওনাকে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। উনি হেলিকপ্টারে গেছেন। দেশের মানুষ দেখেছেন। অতএব পালিয়ে যাওয়া বলে চোরের মতো লুকিয়ে যাওয়াটাকে। তবে এই পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টা আমি ডিফেন্ড করেছি। আমি মনে করি, সন্দেহাতীতভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণ করতে সক্ষম হননি রাষ্ট্রপক্ষ। তাই তারা খালাস পাবেন। সসম্মানে খালাস পাবেন বলেও আমার প্রত্যাশা।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২ জুলাই আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এটিই তার প্রথম সাজা। আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম-খুন ও নির্যাতনের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলা রয়েছে। মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতনের অভিযোগে করা একটি মামলায়ও শেখ হাসিনা আসামি।

Top