কেমিক্যাল গোডাউন ও পোশাক কারখানায় আগুন,পুড়ে অঙ্গার ১৬ শ্রমিক - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কেমিক্যাল গোডাউন ও পোশাক কারখানায় আগুন,পুড়ে অঙ্গার ১৬ শ্রমিক


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া:হতভাগ্য এসব লাশের সবাই পোশাক শ্রমিক বলে জানা গেছে। রাতেই অ্যাম্বুলেন্সযোগে প্রতিটি লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, রাসায়নিকের গুদাম থেকে আসা ক্ষতিকর গ্যাসে অজ্ঞান হয়ে এত প্রাণহানি ঘটেছে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট যোগ দেয়। এছাড়া সহযোগিতা করতে ছুটে আসে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট।দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, গার্মেন্ট ভবনের ছাদের দরজায় তালা লাগানো ছিল। আগুন লাগার পর অনেকে সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু তালা খোলার কেউ না থাকায় রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়ায় অজ্ঞান হয়ে মারা যায়। এরপর আগুনে পুড়ে অঙ্গার হতে হয় হতভাগ্য এসব শ্রমিককে। পাশের কারখানার আগুন দ্রুত সরু গলির ওপারের এই পোশাক কারখানার ভবনের নিচে ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে শিয়ালবাড়ী এলাকায় পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার রাত ১০টা পর্যন্ত ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ কারণে পোশাক কারখানার কর্মীরা নিচে নামতে পারেননি। আবার ছাদের দরজা তালা থাকায় সেখান থেকেও তারা বের হতে পারেননি।

এদিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাত ১০টায় রাসায়নিক গোডাউনের আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। তবে পোশাক কারখানার আগুন বিকালের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এজন্য সেনাবাহিনীর কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞ টিমও আনা হয়। তারা রিমোট কন্ট্রোল ফায়ার ফাইটিং যন্ত্রপাতির মাধ্যমে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন।

এদিকে ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় তিনি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানসহ দায়ীদের চিহ্নিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

এছাড়া বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় শোক জানানো হয়। গভীর শোক জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মঙ্গলবার এক ফেসবুক পোস্টে তিনি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনাসহ আহতদের দ্রুত সুস্থতাও কামনা করেন। পোস্টে তিনি আরও লেখেন, বারবার এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা অনেক দুঃখ এবং প্রশ্ন রেখে যায়। আমাদের অবশ্যই কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সূত্র জানায়, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। পরিস্থিতি বিবেচনায় একপর্যায়ে মোট ১২টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। তাদের সহযোগিতায় সেনাবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে তৎপর থাকতে দেখা যায়। এ সময় ভেতরে আটকা পড়া গার্মেন্টকর্মীদের স্বজনদের ভিড় বাড়তে থাকে। নিখোঁজ স্বজনের আইডি কার্ড ও ছবি বুকে নিয়ে তাদের আহাজারি করতে দেখা যায়। স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদে রূপনগর এলাকার পরিবেশ মুহূর্তেই ভারী হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা সাতটায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, পোশাক কারখানাটির আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। ১৬টি লাশ পোশাক কারখানার বিভিন্ন ফ্লোর থেকে পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কেমিক্যালের গ্যাস ও ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে তাদের বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়েছে। তিনি জানান, লাশগুলোর এমন অবস্থা, যা ডিএনএ টেস্ট ছাড়া পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

এর আগে বিকাল ৪টার দিকে তিনি এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ফায়ারকর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে আগুন দেখতে পান। তবে কেমিক্যাল গোডাউন, না গার্মেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এছাড়া যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তারা নারী না পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না। রাসায়নিক গুদামের অনুমোদন ছিল কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনুমোদনের বিষয়টি আমরা এখনো জানতে পারিনি। তবে যতটুকু শুনেছি অনুমোদন নেই। যাচাই করে তদন্তের পর বলতে পারব।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কেমিক্যাল গোডাউনটির নাম মেসার্স শাহ আলী ট্রেডিং এবং পোশাক কারখানাটির নাম এনএইচ ফ্যাশন। কেমিক্যাল কারখানা মালিকের নাম শাহ আলম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে কেমিক্যাল গোডাউন করে ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। রূপনগরের শিয়ালবাড়ী এলাকার ২ নম্বর রোডের চা বিক্রেতা যুগান্তরকে জানান, দুপুরে বিকট শব্দ পেয়ে এগিয়ে যাই। গিয়ে দেখি কেমিক্যাল গোডাউন ও পাশের এনএইচ গার্মেন্টসে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পাশে রাস্তায় দাঁড়ানো দুই-তিনটি কাভার্ড ভ্যানও আগুনে জ্বলতে দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, কেমিক্যালের গোডাউন থেকেই এই আগুন লেগেছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় আবাসিক এলাকায় বছরের পর বছর এই অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসা চলে আসছে।

সূত্র জানায়, এই এলাকায় বেশ কয়েকটি গার্মেন্টস ও ক্ষুদ্র কারখানা রয়েছে। আগুন লাগার খবরে এসব কারখানা আগে থেকেই ছুটি দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার সময় অনেকেই দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। তাদের কারও হাত, কারও পা পুড়ে গেছে।

সরেজমিন দেখা যায়, কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগার কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনাস্থলের ৩শ গজের মধ্যে কাউকে ঢুকতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংশ্লিষ্টদের দাবি, গোডাউনে ৭ থেকে ৮ ধরনের কেমিক্যাল ছিল। এগুলো থেকে যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে আগুন নেভানোর কাজ অব্যাহত রাখে।

এদিকে আগুনের ঘটনায় দগ্ধ ও আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। তাদের মধ্যে তিনজনকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান যুগান্তরকে জানান, তিনজনের মধ্যে সুরুজ্জামানের শরীরে দুই শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। এছাড়া মামুন ও সোহেল সরদার নামে দুইজন ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছেন। তাদের ‘ইনহাইলেশন ইনজুরি’ রয়েছে। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, ‘মিরপুরের শিয়ালবাড়ীতে যে কারখানায় আগুন লেগেছে, তা বিজিএমইএ-এর সদস্যভুক্ত কোনো পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি ওয়াশিং কারখানা। এটির নাম শাহ আলী ওয়াশিং লিমিটেড। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় সংগঠনটি।

এদিকে নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত অনেকেই বিভিন্ন হাসপাতালে ধরনা দিতে থাকে। অন্তত ২০ জনকে খুঁজতে দেখা গেছে তাদের স্বজনদের। তারা হলেন আসমা (১৪), নারগিস (১৮), মাহিরা (১৩), রবিন (২০), রবিউল (২০), নাজমুল (৪০), সানোয়ার (২০), সামিয়া (১৭), তোফায়েল আহমেদ (২০) ও ফারজানা (২০)। তারা সবাই পোশাক শ্রমিক। স্বজনরা বলছেন, তারা বেঁচে আছেন নাকি আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, তা কেউ নিশ্চিত করছে না। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৫টায় ঘটনাস্থলের পাশে বসে আহাজারি করতে দেখা যায় নিখোঁজ রবিনের স্বজনদের। তার খালা শিল্পী বেগম বলেন, গার্মেন্টসের চারতলায় কাটিং সেকশনে কাজ করত রবিন। তার কোনো হদিস আমরা পাচ্ছি না। শিল্পী বেগম জানান, তার ছেলে ফয়সাল আগুন লাগার সময়ে বেরিয়ে এসেছে। তিনি অভিযোগ করেন গার্মেন্টের নিচতলায় সিকিউরিটি গার্ড তালা মেরে রাখায় অনেকেই ভেতরে আটকা পড়েন। তারা জীবিত না মৃত, কেউ এখনো জানে না।

স্বামীর ছবি বুকে নিয়ে আহাজারি করতে দেখা যায় নাসিমা বেগমকে। তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর বাসিন্দা। নাসিমা বেগম জানান, তার স্বামী নাজমুল (৪০) এই পোশাক কারখানায় অপারেটরের কাজ করতেন। আগুনের খবর পেয়ে তার মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বার্ন ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মিরপুরের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে খুঁজেছেন। কোথাও পাননি স্বামী নাজমুলের হদিস। এরপর স্বামীর ছবি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঘটনাস্থলের পাশে। নাসিমার দাবি, স্বামী বেঁচে না থাকলে তার লাশটার সন্ধানও যেন পান। দুই সপ্তাহ আগে কারখানায় চাকরি নিয়েছিল নারগিস। তার কোনো খোঁজ মিলছে না। মেয়ের ছবি নিয়ে মা সুরমা বেগম আহাজারি করছেন। বলছেন, কেউ আমার নারগিসের সন্ধান দিচ্ছে না। সুনামগঞ্জের রতন মিয়ার মেয়ে ফারজানা হেলপার হিসাবে কাজ করতেন। তাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পোশাক কারখানার শ্রমিক সামিয়াকে খুঁজছেন তার স্বামী নাঈম। কিন্তু তারও হদিস কেউ দিতে পারছে না।

Top