রাজধানীবাসীর ‘গলার কাঁটা’ব্যাটারিচালিত রিকশা - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজধানীবাসীর ‘গলার কাঁটা’ব্যাটারিচালিত রিকশা


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :রাজধানী ঢাকাসহ দেশের শহর-গ্রামে দিন দিন ব্যাটারিচালিত রিকশার দখল বেড়েই চলেছে।নগরবাসীর কাছে তাই এই যান এখন প্রকৃত অর্থেই এক ‘গলার কাঁটা’।কিন্তু এর অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি এখন নগর জীবনের জন্য এক ভয়াবহ সংকটে পরিণত হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন গতি, নিম্নমানের ব্রেকিং সিস্টেম এবং অদক্ষ চালকের কারণে প্রতিদিন ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। বাড়ছে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ব।
ট্রাফিক পুলিশের তথ্য বলছে,ঢাকায় বৈধ অনুমোদনের চেয়ে বহু গুণ বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। অতিরিক্ত সংখ্যা ও বেপরোয়া গতি যানজট বাড়াচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। রাস্তাঘাটে এদের দখলদারি পথচারীদের জন্যও চরম ভোগান্তি তৈরি করেছে।শুধু দুর্ঘটনা নয়, এই যান ছিনতাইকারীদের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে, যা নগরীর নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ফলে রাজধানীর বুকে এই ত্রি-চক্র যান কার্যত ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।স্বল্প খরচ,দ্রুত চলাচলের সুবিধা ও সহজলভ্যতার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এই যান জনপ্রিয়।সরকার ও ট্রাফিক বিভাগ এ সংকট সামাল দিতে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছিল। রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পরীক্ষামূলকভাবে ‘ট্র্যাপার’ (ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণকারী সরঞ্জাম) বসানো হয়েছিল। মনে করা হচ্ছিল এটি রিকশার চলাচল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশাওয়ালারা এসবের তোয়াক্কা করে না।

পরিবেশ ও বিদ্যুৎ খাতেও এই যান বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোয় ব্যবহৃত নিম্নমানের লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি চার্জ দিতে প্রতিটি যান ৪ থেকে ৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ খরচ করে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন এই খাতে নষ্ট হচ্ছে অন্তত ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অবৈধ সংযোগ থেকে চার্জ নেয়ার কারণে বাড়ছে লোডশেডিং, ভোগান্তিতে পড়ছেন বৈধ গ্রাহকরা। এসব যান তৈরির যন্ত্রাংশ আমদানি ও উৎপাদন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা, যাতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিশ্চিত হয়।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত সমন্বিত নীতি প্রণয়ন না করলে ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে। তাই অবিলম্বে এসব যান নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, নইলে নগরবাসীর নিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্য এর মাশুল হবে ভয়াবহ।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা আরও উদ্বেগজনক। ব্যবহৃত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি যথাযথভাবে রিসাইক্লিং না করেই ফেলে দেওয়ায় মারাত্মক সীসা দূষণ ঘটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, সীসা মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, যা দীর্ঘমেয়াদে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানিয়েছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এই ব্যাটারি চালিত থ্রি-হুইলার। ঢাকার সড়কে চলাচলকারী ১৮ ধরনের যানবাহনের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি দেখিয়েছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা সবচেয়ে বিপজ্জনক যান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এই যানগুলোর নকশা দুর্বল, নিরাপত্তা মানদণ্ড নেই, ফলে সামান্য ধাক্কাতেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।

রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকগুণ বেড়েছে। ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনার শিকার।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, তাদের জরিপ অনুযায়ী শুধু ২০২৪ সালে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান দুর্ঘটনায় ৪৫৭ জন নিহত এবং ১ হাজার দুইশজনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ২০-২৫টি দুর্ঘটনা ঘটছে ব্যাটারিচালিত বাহনের কারণে।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) এক্স সিনিয়র কনসাল্ট্যান্ট ডা. এম সি পাল মিন্টু বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন ৪০০–৫০০ জন রোগী জরুরি বিভাগে ভর্তি হন। এর মধ্যে বেশিরভাগই ব্যাটারিচালিত রিকশার দুর্ঘটনায় আহত।

নিউমার্কেট ট্রাফিক জোনের পিআই বুলবুল আহমেদ জানিয়েছেন, অধিকাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক অপ্রশিক্ষিত ও লাইসেন্সবিহীন। সাধারণ রিকশার গতি ঘণ্টায় ১০–১৫ কিলোমিটার হলেও ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি ঘণ্টায় ৩০–৩৫ কিলোমিটার। চালকদের প্রশিক্ষণ ও ট্রাফিক আইনের ধারণা না থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যাটারিচালিত রিকশা এখনও সরকারিভাবে বাংলাদেশে বৈধ নয়। তবু লাখো বেকার মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস হওয়ায় সরকার যেকোনো নিষিদ্ধের চেষ্টা করলে তা বিক্ষোভের মুখে বাধ্য হয়ে প্রত্যাহার করতে হয়। ফলে এই বাহনটি অরাজকভাবে বাড়ছে এবং এখন এটি নিয়ন্ত্রণহীন এক বাস্তবতা হিসেবে দেখা দেয়।

তিনি আরও বলেন, হঠাৎ করে এসব রিকশা নিষিদ্ধ না করে ধাপে ধাপে বিকল্প কর্মসংস্থান, নিরাপদ নকশা ও নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিদ্যুৎ অপচয় রোধে চার্জিং স্টেশন ও ব্যাটারি রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া চালু করা জরুরি। যদিও যাত্রীদের কাছে ব্যাটারিচালিত রিকশা দ্রুত ও সাশ্রয়ী বাহন, অনিয়ন্ত্রিত গতি, কাঠামোগত দুর্বলতা, পরিবেশ দূষণ এবং নীতিহীনতার কারণে এটি এক ভয়াবহ মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। তাই নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, প্রশিক্ষণ, নিবন্ধন এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মাধ্যমে এই ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব।জুরাইন এলাকার গৃহিণী রুবিনা আক্তার বলেন, প্রতিদিন বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করি এ রিকশায়। হঠাৎ গতি বাড়ানো বা ব্রেক করার কারণে কয়েকবার পড়ে গিয়ে আমি আর আমার সন্তান আহত হয়েছি। ধীরে চালাতে বললেও চালকরা আমাদের কথা মানতে চায় না।

বেসরকারি চাকরিজীবী মেহদী নাফি বলেন, রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো ভাইরাসে পরিণত হয়েছে। পরগাছার মতো এলাকার সরু গলি, রাস্তার মোড়, মূল সড়কে উঠে পড়েছে। বাস চলাচল করে এমন রাস্তায় রিকশার মতো হালকা যান চলাচল ঠিক নয়। কিন্তু সরকারের বেখেয়ালিপনার কারণে এ সমস্যা প্রকট হয়েছে। এই রিকশাগুলো প্রথমদিকে শারীরিকভাবে কিছুটা অক্ষম ব্যক্তিদের বেকারত্ব ঘোচানোর জন্য দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন সব বয়সীরা এ যান নিয়ে রাস্তা দখল করেছে। বিগত সরকারের আস্কারার কারণে এই সমস্যা দেশব্যাপী প্রকট হয়েছে। এখন সড়ক শৃঙ্খলা রক্ষায় বর্তমান সরকারের শক্ত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কিন্তু তারা নেবে না। ফলে এই বিষফোঁড়া বুকে বয়ে চলতেই হবে।

আসলাম নামে প্যাডেল রিকশার চালক জানান, যাত্রীরা তাদের রিকশায় উঠতে চায় না। তাদের রিকশাগুলোর দুর্ঘটনার সংখ্যা সাধারণত কম। তারা সরকারের কিছু নিয়ম মানেন। কিন্তু ব্যাটারিচালিক রিকশাওয়ালার নিয়মের তোয়াক্কা করে না। তা ছাড়া এ ধরনের রিকশা চালায় অপ্রাপ্তবয়স্ক বা শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষ। ফলে সাধারণ যাত্রীদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুলল হক বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা আমাদের নগর পরিবহন ব্যবস্থায় অননুমোদিত সংযোজন। এগুলোতে কোনো স্ট্যান্ডার্ড নেই, অথচ রাস্তায় নামার পর মানুষের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ছে। তিনি সতর্ক করেছেন, সরকার যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না নেয়, তবে বড় ধরনের জননিরাপত্তা সংকট তৈরি হবে।

Top