দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া আদায় না হওয়ায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে
মু.এ বি সিদ্দীক ভুঁইয়া:দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া আদায় না হওয়ায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে উৎপাদন ও সরবরাহের প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। বিতরণ ব্যবস্থায় এক ধরনের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছে বড় অঙ্কের বকেয়া আটকে যাওয়ায় আর্থিক টানাপোড়েনে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সংস্থাগুলোর কাছে ২৬১২ কোটি টাকা বকেয়া দাঁড়িয়েছে।এই বকেয়া বিলের মধ্যে সরকারপ্রধানের অফিসের ১২ কোটি এবং খোদ বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১২ কোটি টাকাও আছে। এদিকে টাকার সংকট কাটাতে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টার কাছে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চেয়ে আধা সরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির জানান, ‘বিপুল পরিমাণ বিল অনাদায়ী থাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা বা কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া তাদের বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য অর্থ বিভাগকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে বলা হয়েছে।
সূত্রমতে, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সরকারের ৫৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে ‘ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি)’ বকেয়া পাওনা দাঁড়িয়েছে ৭৭৩ কোটি টাকা। বকেয়ার দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ‘ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লি. (ডেসকো)’। এ সংস্থার বকেয়া বিলের পরিমাণ ৫৫৪ কোটি টাকা এবং তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বাবিউবো)। এ প্রতিষ্ঠানের মোট বকেয়া বিলের অঙ্ক ৪৫৬ কোটি টাকা। এছাড়া নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লি. (নেসকো) বকেয়া পাওনা ৩৭১ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে (বাপবিবো) পাওনা ২৪৫ কোটি টাকা এবং ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. (ওজোপাডিকো) বকেয়া ২১১ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কয়েক বছর ধরে মিটিং করে, চিঠি দিয়ে, এমনকি আইনি পদক্ষেপ নিয়েও এই বকেয়া বিল আদায় করতে পারছে না বিতরণ কোম্পানিগুলো। তাদের মতে, পুঞ্জীভূত বকেয়া পরিশোধের জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অর্থ বিভাগ যাতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ রাখে, সেই সুপারিশ করে চিঠি পাঠানোর জন্য তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
সূত্র আরও জানায়, বকেয়া বিল আদায়ে আগেও দুবার সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রধানদের কাছে আধাসরকারি পত্র (ডিও লেটার) পাঠিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ। সেখানে তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এ বকেয়ার কারণে সার্বিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায়ের ব্যাপারে সর্বশেষ গত ৯ সেপ্টেম্বর পুনরায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে ডিও লেটার দিয়েছেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা। সেখানে তিনি বলেছেন, বর্তমান সরকার স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে উৎপাদন ক্ষমতা ৩১ হাজার ৫০৫ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে। বিতরণকারী কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের সরবরাহ করছে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ বিল দীর্ঘদিন বকেয়া থাকার কারণে সার্বিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিতরণকারী সংস্থাগুলোকে বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রেও আর্থিক সংকটে পড়তে হচ্ছে।
সূত্রে জানা গেছে, এই বকেয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৯৫ কোটি টাকা হচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিডি)। এই বিভাগের আওতাধীন সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসা, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ।এলজিডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বেশির ভাগ বকেয়া রয়েছে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ অফিসগুলোতে। এছাড়া ওয়াসাগুলোতেও উল্লেখযোগ্য বকেয়া রয়েছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো সড়কবাতি সেবা দিয়ে থাকে; এসব সড়কবাতির জন্য অনেক বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৯৪ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ সংস্থাগুলোর। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের কারণে এই মন্ত্রণালয়ের মোট বকেয়া অনেক বেড়েছে। এ কার্যালয়ের অধীনে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি এবং ভাসানচরের একটি শরণার্থী ক্যাম্প রয়েছে। এসব ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল সরকার পরিশোধ করে থাকে। মোহাম্মদপুরের বিহারি কাম্পের ২৪০ কোটি টাকা বকেয়াও এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে।এছাড়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২৩৯ কোটি টাকা, গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিভাগের ১৩৩ কোটি টাকা, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ৮০ কোটি টাকা, জননিরাপত্তা বিভাগ ৭৮ কোটি টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৭২ কোটি টাকা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ৭০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।