সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি মানতে হবে
মোহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম:সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি মানতে হবে। বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোতে যদি আবার নির্বাচন হয়, তাহলে এ নির্বাচনের মাধ্যমে আরেকটি ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে, আরেকটি হাসিনার জন্ম হবে। পৃথক বিক্ষোভপূর্ব সমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন প্রশ্নে গণভোট দিন।পিআর ও জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনসহ নানা দাবিতে বৃহস্পতিবার রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ সাত দল। অভিন্ন এ কর্মসূচি পৃথকভাবে পালন করে দলগুলো। কর্মসূচিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, বর্তমান সময় হচ্ছে জুলাই সনদ এবং জুলাই ঘোষণার আইনি ভিত্তি দেওয়ার উপযুক্ত সময়।
এদিন জামায়াত ছাড়াও ছয়টি দল অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। অন্য দলগুলো হলো-ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাগপা। দলগুলোর নেতারা তাদের বক্তব্যে অবিলম্বে আওয়ামী লীগের দোসর ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানান। সাতটি দলের অভিন্ন তিন দিনের কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে আজ দেশের সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করবে। এছাড়াও ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের সব জেলা বা উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল করবে।দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন, পিআর পদ্ধতি চালু, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণ, ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারী শক্তির দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণ। তবে দাবির মধ্যে পিআর পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে।এদিকে, সাত দলের পৃথক বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুরানা পল্টন-গুলিস্তান ও এর আশপাশের এলাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ।
পিআর ও জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হতে হবে-জামায়াত : ৫ দফা দাবিতে বিকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণ জামায়াত আয়োজিত বিক্ষোভপূর্ব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, বর্তমান সময় হচ্ছে জুলাই সনদ এবং জুলাই ঘোষণার আইনি ভিত্তি দেওয়ার উপযুক্ত সময়। তিনি প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আপনি সবাইকে ডাকুন, কনস্টিটিউশনাল অর্ডারের মাধ্যমে অথবা একটা রেফারেন্ডামের মাধ্যমে এখনো সময় আছে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিয়ে নির্বাচন করুন।
গোলাম পরওয়ার সরকারের উদ্দেশে আরও বলেন, আপনারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড মেইনটেইন করতে পারছেন না। তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কীভাবে? তাই আমাদের দাবি-আপনারা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিন। সাংবিধানিক অর্ডার জারি করুন। গণভোট দিন। ফ্যাসিবাদের কার্যক্রম স্থগিত করুন। আপনারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘নির্বাচনের আগে দৃশ্যমান বিচার করবেন।’ আমাদেরও দাবি নির্বাচনের আগেই তা দৃশ্যমান করতে হবে।তিনি বলেন, আমাদের দাবি পিআর মানতে হবে। জরিপে ৭০ ভাগ মানুষ পিআরের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। ঐকমত্য কমিশনে ৩১ দলের মধ্যে ২৫টি দল পিআরের পক্ষে রয়েছে। একটি দলের কেউ কেউ বলছেন, পিআর খায় না মাথায় দেয়। কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি তো এটা বলতে পারেন না। তাই পিআর বাস্তবায়নের জন্য গণভোট দিন। রায় পিআরের পক্ষে আসে নাকি বিপক্ষে আসে, যাচাই করুন।
ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ জামায়াতের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে এবং সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিমের যৌথ সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন-সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ। আরও উপস্থিত ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মোয়াযযম হোসাইন হেলাল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমির ড. হেলাল উদ্দিন, সহকারী সেক্রেটারি দেলাওয়ার হোসাইন, অ্যাডভোকেট কামাল হোসাইন, ড. আবদুল মান্নান, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান, ডা. ফখরুদ্দিন মানিক, নাজিম উদ্দিন মোল্লা, ইয়াসিন আরাফাত প্রমুখ। বিক্ষোভ মিছিলটি বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে শুরু হয়ে জিপিও মোড়, পল্টন মোড় ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে মৎস্যভবন মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।
পিআরেরও দু-একটা সাইড এফেক্ট আছে, কিন্তু অধিকাংশই ভালো দিক-ইসলামী আন্দোলন : পাঁচ দফা দাবিতে বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে গণসমাবেশ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন প্রশ্নে গণভোট দিন। জনগণ যদি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না চায়, তাহলে ইসলামী আন্দোলন এ পদ্ধতির দাবি আর করবে না। তিনি আরও বলেন, পিআরের বিপক্ষে কিছু নেই, তা বলব না। কেউ ওষুধ যখন সেবন করে, সেখানে লেখা থাকে-এর সাইড এফেক্ট (পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া) আছে। পিআরের ব্যাপারেও দু-একটা সাইড এফেক্ট আছে। কিন্তু এর অধিকাংশই ভালো দিক।
সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, সংস্কার করতে হবে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে, বিচার দৃশ্যমান হতে হবে এবং পিআরে নির্বাচন হতে হবে। এটা জনতার দাবি। কেন আপনারা এই দাবি মানছেন না? সমস্যা কোথায়? সংস্কার ও বিচারের আগেই যদি নির্বাচন নির্বাচন করেন, তাহলে আমরা ধরে নেব সরকার কোনো দল বিশেষের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, যুগপৎ আন্দোলন হলো, একই দাবিতে যার যার মতো আন্দোলন করা। যুগপৎ আন্দোলন কারও নেতৃত্বে হয় না। কিন্তু কেউ কেউ এই যুগপৎ আন্দোলনকে বিশেষ কোনো দলের নেতৃত্বে বলে বর্ণনা করছেন। এটা যথার্থ নয়। দলটির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আয়োজিত গণসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন দক্ষিণের সভাপতি মাওলানা ইমতেয়াজ আলম। আরও ছিলেন-উত্তরের সভাপতি অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, দলের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মাওলানা আহমদ আব্দুল কাউয়ুম, মুফতি রেজাউল করীম আবরার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, কেএম শরীয়াতুল্লাহ, মাওলানা আরিফুল ইসলাম, মাওলানা দেলওয়ার হোসাইন সাকি, মাওলানা খলিলুর রহমান প্রমুখ। সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। মিছিলটি পল্টন মোড় হয়ে বায়তুল মোকাররমে গিয়ে দোয়া ও মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। আজ একই দাবিতে বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় বাড্ডা ও ধোলাইখাল এলাকায় দুটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে জাতীয় বিপর্যয় অনিবার্য-বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ : পাঁচ দফা দাবিতে বাদ আসর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের যৌথ উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ। মিছিলপূর্ব সমাবেশে দলটির মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ঘোষণার মাধ্যমে অবিলম্বে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এর ভিত্তিতেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। তিনি বলেন, হাজার হাজার ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র চলছে। যারা আগামী সংসদের জন্য জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ঠেলে দিতে চায়, তারা আসলে রাজনৈতিক সুবিধার খোঁজ করছে। এখনই দেশের ও জনগণের কল্যাণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে জাতীয় বিপর্যয় অনিবার্য। এছাড়া কোনো নির্বাচনি প্রক্রিয়া দেশ ও জাতির কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। তিনি বলেন, জুলাই গণহত্যার বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন অর্থহীন হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ফ্যাসিবাদের বিচার দৃশ্যমান না হলে জাতির ঐক্য টেকসই হবে না।
ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মাওলানা আনোয়ার হোসেন রাজীর সভাপতিত্বে ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাকিবুল ইসলামের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও ছিলেন-যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, মাওলানা তোফাজ্জল হোসাইন মিয়াজি, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা এনামুল হক মূসা, মাওলানা ফয়সাল আহমদ, মাওলানা আবুল হাসানাত জালালী, মাওলানা আবু সাঈদ নোমান, অফিস সম্পাদক মাওলানা রুহুল আমিন খান, প্রচার সম্পাদক মাওলানা হাসান জুনাইদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মাওলানা ছানাউল্লাহ আমীনি, ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুর্শিদ সিদ্দিকী প্রমুখ।
এছাড়াও বিকালে খেলাফত মজলিশ ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। বিক্ষোভ সমাবেশ করে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টিও। অভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)। বিকালে ৭ দফা দাবিতে বিজয় নগর পানির ট্যাংকি থেকে পল্টন মোড় হয়ে বিক্ষোভ মিছিল প্রেস ক্লাবের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এতে দলটির সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইকবাল হোসেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য আসাদুর রহমান খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।