তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনে লাগবে গণভোট - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনে লাগবে গণভোট


মু.এ বি সিদ্দীক ভুঁইয়া:তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। তবে বিদ্যমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তির পর ভবিষ্যতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে। মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা শেষে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ তথ্য জানান। এসময় আগামী সপ্তাহে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।আলোচনায় সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, যদি উচ্চকক্ষ গঠিত না হয় বা উচ্চকক্ষ হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের সংশোধনের জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের প্রয়োজন হবে। তবে সুনির্দিষ্ট কিছু অনুচ্ছেদ যেমন প্রস্তাবনা, রাষ্ট্রের মূলনীতি, অনুচ্ছেদ ৪৮, ৫৬, ১৪২ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিষয়ক ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ এবং ৫৮ঙ অনুচ্ছেদের দ্বারা সংবিধানে যুক্ত করতে হলে তা সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ও জোট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সমর্থন দিয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, প্রথম পর্যায়ের আলোচনায়ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এ মত প্রকাশ করেছে। তবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আজও ঐকমত্য হয়নি। এ ব্যাপারে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে ভোটের সংখ্যানুপাতে যেন উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অন্যদিকে আসনের সংখ্যানুপাতেও উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো এ বিষয়ে একাধিক আলোচনার পরেও ঐকমত্যের জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি, সেহেতু দল এবং জোটগুলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার কমিশনের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট বিষয়ে নিজেদের মধ্যে এবং পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আগামী সপ্তাহে একটি অবস্থানে আসার আশা প্রকাশ করেন তিনি।

ভবিষ্যতে যেন কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে হাত না দিতে পারে : সংলাপ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সংশোধনীটা শক্তিশালী অবস্থা করতে চাই। ভবিষ্যতে যেন কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে হাত না দিতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায়ও যদি কেউ পরিবর্তন আনতে চায় সেটাও গণভোটের মাধ্যমে করার প্রস্তাব দিয়েছি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে তিনি বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট রিপ্রেজেন্ট করবে বিদ্যমান সংবিধানে সংরক্ষিত নারী আসন যেভাবে হয়, আসনের অনুপাতের সেই হিসাবে। তবে বিষয়টা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে। কেউ চান পিআর পদ্ধতিতে মানে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে, এখানে আবার পাওয়ার ফাংশনের বিষয় আছে। সাধারণ বিল কিভাবে পাশ হবে, কনস্টিটিউশন এমেন্ডমেন্ট হলে আপার হাউজে কিভাবে পাশ হবে ইত্যাদি ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্যে আসা যায়নি।

এই মুহূর্তে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজন আছে কিনা সেই প্রশ্ন অনেক দল তুলেছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, আমাদের দেশের যে আর্থিক সক্ষমতা, সেখানে আরেকটি পার্লামেন্ট সৃষ্টি করা এবং সেই পার্লামেন্ট যদি আসলে নিুপক্ষের রিপাবলিক হয়। তাহলে সেটার প্রয়োজন আছে কিনা সে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কারণ, এটাও একটা আলাদা পার্লামেন্টের মতো ব্যয়বহুল হবে। সেই সব বিষয়ে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন সবার মতামত নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত দেবে রোববার। সংবিধান সংশোধনীসংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে বিএনপি নেতা বলেন, কিভাবে সংবিধান সংশোধন করা যায় এবং বিদ্যমান সংবিধান কিভাবে সংশোধিত করা যায় সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।

পিআর পদ্ধতি আটকে যাওয়া ইনজাস্টিস হবে : সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা মনে করি, কোনো একটি বড় দল বা তিনটি দল না চাইলে পিআর পদ্ধতি আটকে যাওয়াটা ইনজাস্টিস হবে, বৈষম্য হবে। কারণ মেজরিটি তো পক্ষেই আছে। কোনো এক জায়গাতে একটা সলিউশন দিতে হবে। মেজরিটি সংখ্যক দলই পিআর পদ্ধতিকেই সাপোর্ট দিচ্ছে। শুধু এক লাইনে ব্যাখ্যা দিতে চাই, জনসমর্থনের দিক থেকে পাঁচটা-ছয়টা দল হলো, এনসিপি, চরমোনাই পীর, সব ইসলামী দল, গণঅধিকার পরিষদ। আমরা (জামায়াতে ইসলামী) পিআরের পক্ষে আছি।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট নিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, কয়েকটি দল ছাড়া সবাই আমরা একমত হয়েছি, দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট চাই। দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট চায় না এরকম বোধ হয় একটি বা দুটি দল বলেছে। তবে কিছুটা ডিফারেন্স হচ্ছে এর ফরমেশনের বিষয়, কিভাবে এটা গঠন করবে এবং এর ফাংশন কি হবে? সে নিয়ে একটা কমিশনের প্রস্তাব আসছে। এগুলো সংযুক্ত করা হয়েছে। কমিশন সব শুনেছে ও বক্তব্য রেখেছে এবং কমিশন বলেছে, রোববার কমিশনই এ বিষয়টা চূড়ান্ত করবে। জামায়াতে ইসলামীর এই নেতা বলেন, সংবিধান সংশোধনটাকে একটু কঠিন করে দেওয়া হয়েছে এবং কোনো একক দল যেন সংবিধান সংশোধন ইচ্ছামতো করতে না পারে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন হোক। শুধু এক দলের জন্য নয়। মোট বিষয়টা হচ্ছে সংবিধান সংশোধন করা একটু কঠিন করা। যাতে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সবাই সেখানে ঐক্যবদ্ধ হয়।

আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, বাংলাদেশের মানুষ একটা পরিবর্তন চায় এবং এমন একটি সিস্টেমে আমরা আনতে চাই, যেটা আমরা বরাবরই সহজ করে বলি। ফ্যাসিস্ট যেন ফিরে না আসে। এজন্য যত ফাঁক আছে, ছিদ্র আছে, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। যদি ছিদ্র ছোটও রাখেন; এই ছোট ছিদ্র অনেক সময় বড় হয়ে যায়। এখানে ঢোরা সাপও ঢুকতে পারে, বিষধর সাপও ঢুকতে পারে। সুতরাং ছিদ্র রাখা যাবে না।

মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে এনসিপি ছাড় দেবে না : জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, মৌলিক সংস্কারের প্রশ্ন যখন আসছে, যখন সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটা সমন্বিত নিয়োগ কমিটির কথা আসছে, তখন সেখানে তারা বেঁকে বসছেন। যখন চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের জন্য উচ্চকক্ষের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা আসছে, তখন তারা সেখান থেকে সরে এসেছে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র একটা ভাঙা পা নিয়ে চলছে। সেই ভাঙা পায়ে তারা ব্যান্ডেজ করেছে। তারা স্যাভলন দিয়েছে। কিন্তু হাড়টাকে যে জোড়া লাগাতে হবে, সেই জায়গাটাতে এসে তারা বেঁকে বসেছে। তাদের (বিএনপির) কথা হলো ব্যান্ডেজ করেছি, স্যাভলন দিয়েছি। এটাই যথেষ্ট। এটাই মেনে নাও। হাড়টাকে জোড়া লাগানো এতদূর পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

আখতার বলেন, আমরা এই জায়গায় স্পষ্ট করে বলি-মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে জাতীয় নাগরিক পার্টি কোনো ছাড় দেবে না। সংস্কারের প্রস্তাবনা, আলোচনাগুলো টেবিলের আলোচনার মধ্যেই সমঝোতা হবে। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার জায়গা থেকে সংস্কারের প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের পথে যাবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। আর যদি মৌলিক সংস্কারকে বাধাগ্রস্ত করা হয়, মৌলিক সংস্কারবিহীন জুলাই সনদের দিকে আমাদের অগ্রসর করার কথা ভাবা হয়, বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার জয়গাগুলো পূরণ হবে না। সেক্ষেত্রে টেবিলের বাইরে মাঠ সংস্কারের প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরি করা হলে, আমাদের সে পথেই অগ্রসর হতে হবে।

দ্বিতীয় দফা সংলাপের ১৪তম দিনের আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। কমিশনের সদস্য হিসাবে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।

Top