মিলেমিশে লুটপা,অনিয়মই যেখানে নিয়ম
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক,আলোকিত বার্তা :বাংলাদেশ সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতিতে অনিয়মই পরিণত হয়েছে নিয়মে। ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন দোকান ও স্টলের জন্য কেনা ৯০ লাখ টাকার বাজারের হিসাবে সাধারণ সম্পাদকের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ব্যাংক লেনদেনের হিসাবে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৪১ টাকার গরমিল ধারা পড়েছে সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে। সমিতির ১৩ লাখ টাকার এফডিআর একাধিকবার ভাঙানোর ঘটনা ঘটেছে। বিগত ২০ বছরে এফডিআর থেকে এক টাকাও পায়নি সমিতি। বিগত সরকারের সময় ঢাকা জেলা পরিষদ থেকে সমিতির অফিসে ব্যবহারের জন্য একটি কম্পিউটার, ২টি প্রজেক্টর, একটি এলইডি টিভি, ৪৮টি ছোট চেয়ার, সভাপতি ও সম্পাদকের দুইটি বড় টেবিল ও চেয়ার ক্রয় বাবদ ৮ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। তবে সমিতির অফিস এই মালামালের একটিও বুঝে পায়নি। পণ্যগুলো শুধু কাগজে-কলমে দেখানো হলেও বাস্তবে কোনো মালামাল কেনা হয়নি।
ভুয়া এজিএম (বার্ষিক সাধারণ সভা) দেখিয়ে সমবায় অধিদপ্তরকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগ রয়েছে বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে। কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতি, কোষাধ্যক্ষ ও ম্যানেজার একে অপরকে দোষারোপ করছেন। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতির আয় ও ব্যয়ের কোনো স্বচ্ছতা নেই। আয় ও ব্যয়ের লেজার বা রেজিস্টার সংরক্ষণ করা হয় না। তদন্তকালে আয়-ব্যয়ের হিসাব চাওয়া হলে তা দেখাতে পারিনি ব্যবস্থাপনা কমিটি।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, পরিচালক মো. মহিবুল আলম সরকার ৯০ লাখ টাকার বাজার করে এর কোনো হিসাব জমা দেননি। তিনি বলেন, হিসাব চাওয়ার কারণে তিনি আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। ম্যানেজার রুহুল আমীন বলেন, মহিবুল আলম সরকার ৯০ লাখ টাকার বাজার করেছেন; কিন্তু কোনো হিসাব দেননি। সাধারণ সম্পাদকের অনুমোদনও নেননি। তিনি আরও বলেন, মহিবুল আলম সরকার ও সহসভাপতি মো. আব্দুস ছালাম সমিতির হিসাব থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন; কিন্তু দিচ্ছেন না। কর্মচারীর বেতনও বকেয়া রয়েছে তিন লাখ টাকা।বাংলাদেশ সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে উঠে এসেছে অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র। ধারাবাহিকভাবে সমিতিতে লুটপাট চলছে বলে জানানো হয় তদন্তের প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়,নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত সব পরিচালক সমানতালে তছরুপ করেছেন সমিতির অর্থ।সমিতির এক ব্যবস্থাপনা কমিটির আয়-ব্যয়ের হিসাব নেয় না পরবর্তী কমিটি। সাড়ে ৪৮ কাঠা জমি খেয়ে ফেলেছেন সমিতির সাবেক নেতারা। ক্যান্টিনে প্রতিদিন লাখ টাকার বেশি বেচাকেনা হলেও সমিতির লাভ হয় না। উল্টো বকেয়া ২৯ লাখ টাকার গ্যাস বিল। বিভিন্ন পাইকারি দোকানে বকেয়া আছে কয়েক লাখ টাকা। অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত সদস্যদের নামের শেয়ার ও নম্বর বিক্রি করে ২৬ লাখ টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করেছে ব্যবস্থাপনা কমিটি।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও গত ৫০ বছরে সমিতির কর্মচারী নিয়োগসংক্রান্ত কোনো বিধি কাঠামো হয়নি।৩৩ কর্মচারীর বেতন ও বোনাসের বকেয়া কয়েক লাখ টাকা।
গত জানুয়ারিতে সমবায় অধিদপ্তরের রমনা থানার সমবায় কর্মকর্তা ও কেরানীগঞ্জ উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা যৌথভাবে বিষয়টি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। সবকিছু কমিটিগুলোর ধারাবাহিক গাফিলতির ফল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।এতে আরও বলা হয়, অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে পুরোনো কমিটিগুলো দায় এড়ানোর আইনগত কোনো সুযোগ নেই। ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন হয়েছে তা বাতিলের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কারণ যে ভোটার তালিকার ওপর ভিত্তি করে কমিটি গঠন হয়েছে সেই তালিকা আইনসিদ্ধ ছিল না।আর্থিক লেনদেনের বার্ষিক অডিট না করাকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসাবে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। বিধি অনুযায়ী না হওয়ায় দুই হাজার ৩১ জনের সদস্য পদ বাতিলের সুপারিশও করেছে তারা।
জানতে চাইলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন,সমিতির আয় হয় না,কর্মচারীর বেতন দিতে পারি না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় আগের কমিটি ৫০ হাজার টাকা ঋণ রেখে গেছে। ২৬ লাখ টাকা গ্যাস বিল বাকি ছিল।’
মাসে ২২ লাখ টাকা টার্নওভার সত্ত্বেও কেন লাভ হয় না এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মুজিবুর রহমান। সমিতির অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত সদস্যদের নামের প্রতিটি শেয়ার ১১০০ টাকা দরে বিক্রি করে, সর্বমোট ২৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো টাকা নেইনি।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যাচাই করে জানা গেছে, ১৯৫৯ সালে বাংলাদেশ সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতি গঠন করেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ সমতির সদস্য পদ লাভের সুযোগ পেয়েছেন। শেয়ারমূল্য ছিল ১০ টাকা। ১৭ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুকূলে বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতর দুটি ক্যান্টিন, সচিবালয়ের বাহিরে পরিকল্পনা কমিশনে একটি ক্যান্টিন বরাদ্দ দেয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
সমিতির মাধ্যমে মুদি-মনিহারি পণ্য বিক্রির জন্য একটি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। সমিতির মালিকানায় বেকারি, চা স্টল, স্টেশনারি ও পান-সিগারেটের দোকানও আছে। মিষ্টি, তরল ও পাউডার দুধ এবং ফাস্টফুড বিক্রির জন্য আছে পৃথক স্টল।
ক্যান্টিনগুলোর জন্য কোনো অ্যাডভান্স বা জামানত নেই। দিতে হয় না বিদ্যুৎ ও পানির বিল। শুধু গ্যাস বিল দিয়ে চালু রাখতে হয় ক্যান্টিনে রান্নার কাজ। সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার বিক্রি হয় ক্যান্টিনে। ফাস্টফুড আইটেম চলে বিকাল পর্যন্ত।
এছাড়া প্রতি মাসে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে ৮০ টন চাল ও আটা বিক্রির কমিশন থেকে আয় হয় ৮০ হাজার টাকা। ক্যান্টিন, ফাস্টফুড, চায়ের স্টল ও পান-সিগারেটের দোকানে গড়ে প্রতিদিন এক লাখ থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র-শনিবার ছাড়া সপ্তাহে পাঁচ দিন চলে এসব দোকান।এতো সুযোগ-সুবিধার পরও সমিতি এসব ক্যান্টিন ও দোকান থেকে কোনো লাভ করতে পারছে না। বিভিন্ন পাইকারি দোকানে রয়েছে কয়েক লাখ টাকার বকেয়া। সমবায় অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বিষয়টিকে রহস্যজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সমিতির আর্থিক লেনদেনের বার্ষিক অডিট করা হয় না। এটাকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসাবে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। আর্থিক লেনদেনের কোনো রেকর্ডও সংরক্ষণ করা হয় না। এতে ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।কমিটি নানা অজুহাতে তদন্ত কমিটিকে তথ্য ও নথিপত্র দিয়ে সহযোগিতা করেনি বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়। ফলে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন না দিয়ে সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন দাখিল করে কমিটি।
নথিপত্র অনুসারে, সমবায় সমিতির নামে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত গাজীপুর বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পার্শ্বে ধারাইল মৌজায় ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে কেনা হয় সাড়ে ৪৮ কাঠা জমি। ওই জমি সমিতির নামে কেনা হলেও ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত যেসব নেতা দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা ওই জমি নিজেদের নামে লিখে নেন। পরে তারা প্লট করে কেউ ঘরবাড়ি তৈরি করে বংশানুক্রমে ভোগ করছেন। আবার কেউ বিক্রি করে চলে গেছেন। ৩৫ হাজার টাকা কাঠা দরে কেনা জমি বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ টাকা করে বেচাকেনা হচ্ছে। সেই হিসাবে নয় কোটি ৭০ লাখ টাকা মূল্যের সম্পত্তি গিলে ফেলেছেন সমিতির নেতারা। এমনকি সমিতি অফিসে ওই জমির একটি পর্চা ছাড়া আর কোনো দলিল, নামজারি, খাজনার রসিদ, ভায়া দলিল কিছুই নেই। পর্যায়ক্রমে যারা সমিতির দায়িত্বপালন করেছেন কেউ এ বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান, তদন্ত বা খোঁজখবরও রাখেনি।সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি বেহাত হওয়ার পরও কমিটিগুলোর নেতারা এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি। এটা তাদের ধারাবাহিক গাফিলতি। এর দায় এড়ানোর আইনগত কোনো সুযোগ নেই।
সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সমিতির একটি কমিটির মেয়াদ শেষে নতুন কমিটির কাছে হিসাবপত্র, আয়-ব্যয়, সম্পত্তির দলিল-দস্তাবেজ, রেকর্ডপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার কোনো রেওয়াজ নেই। আগের কমিটির কাছ থেকে নতুন কমিটির হিসাব বুঝে নেওয়ার কোনো নজির নেই। সমবায় সমিতি বিধিমালা অনুসারে সমিতির রেজিস্টারে সদস্যদের হালনাগাদ নাম লিপিবদ্ধ করা নেই। ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই বিধি অনুসারে নির্ধারিত শেয়ার, শেয়ারের সমপরিমাণ সঞ্চয় আমানত এবং ভর্তি ফি গ্রহণ ছাড়া এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে ২০২২ সালে এক হাজার ২০০ জনকে, ২০২২-২৩ সালে এক হাজার ২৯ জনকে সদস্য করা হয়েছে। আইন অনুসারে না হওয়ায় তাদের সবার সদস্য পদ বাতিলের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
সমবায় আইন অনুসারে বছরে একবার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের নিয়ম রয়েছে। সাধারণ সভায় উপস্থিত সদস্যদের স্বাক্ষর সংবলিত তালিকা সমবায় অধিদপ্তরকে জানানোর নিয়ম। সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা কমিটিসহ আগের কমিটিগুলো ধারাবাহিকভাবে এ নিয়ম অমান্য করে চলছে।
২৭ বছর পর ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যে ব্যবস্থপনা কমিটি গঠন হয়েছে তা বাতিলের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কারণ যে ভোটার তালিকার ওপর ভিত্তি করে কমিটি গঠন হয়েছে সেই তালিকা আইনসিদ্ধ হয়নি। সমবায় আইন অনুসারে বার্ষিক সাধারণ সভা করে বার্ষিক আয় ও ব্যয় নির্বাহের জন্য মূলধন ও রাজস্ব বাজেট অনুমোদনের শর্ত রয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি সাধারণ সভায় অনুমোদন ছাড়া যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করেছে। ফলে গুরুতর আর্থিক বিধান লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি সম্মিলিতভাবে দায়ী এবং তাদের কাছ থেকে ব্যয়িত অর্থ আদায় করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
সমিতির ম্যানেজার মো. রুহুল আমীন বলেন, ১৯৯৩ সাল থেকে আমি প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত। এখানে কেউ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কল্যাণে কাজ করেছে বলে মনে হয়নি। সবাই আসেন আখের গোছাতে। প্রতিদিনের বাজারে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ হয়। কেউ কোনো হিসাব দেন না। ঠিকমতো ভাউচার না দিয়ে মনমতো খরচ করেন।
তিনি আরও বলেন, ২৭ বছর পর ২০২৩ নির্বাচনে যে কমিটি গঠন হয়েছে। তারাই সবচেয়ে বেশি অনিয়ম করেছেন। অথচ তাদের কাছে স্বচ্ছতার প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। সমিতির সাধারণ সম্পদকসহ অন্য পরিচালকরাও নানা ভাবে সমিতির ফান্ড তছরুপ করেছেন। সমিতির অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত সমদস্যদের নামের শেয়ার বিক্রি করে ২৬ লাখ টাকা আয় হয়েছে। প্রতি শেয়ার ১১০০ টাকা করে বিক্রি করেছে। এখান থেকে ১০০ টাকা সমিতির ফান্ডে জমা রেখেছে। বাকি মোট ২৬ লাখ টাকা ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালকরা জনপ্রতি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা হারে ভাগ করে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে পরিচালক মহিবুল আলম সরকার বলেন,আমি কোনো বাজার করিনি। এসব মিথ্যা অভিযোগ। সাধারণ সম্পাদক যেন সমিতির হিসাব প্রকাশ করেন এবং দৈনিক বাজারের হিসাব দেন, এজন্য আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। সহসভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, মহিবুল কোনো বাজার করেননি। বরং মুজিবুর এবং ম্যানেজার টাকা মেরেছেন। ম্যানেজার আমার কাছে কোনো টাকা পাবেন না। আমি টাকা নিয়েছে-এমন কোনো প্রমাণও তিনি দেখাতে পারবেন না।
সিটি ব্যাংকে সমিতির ১৩ লাখ টাকার এফডিআর একাধিকবার ভেঙে ক্যান্টিনের বাজার করেছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ব্যাংকে সমিতির ১৩ লাখ টাকা এফডিআর ছিল, তা একাধিকবার ভাঙা হয়েছে। ২০১১ সালে ব্যবস্থাপনা কমিটি এফডিআর ভেঙে সমিতির ফান্ডে ৫ লাখ টাকা রেখে বাকি ৮ লাখ টাকা ফের এফডিআর করে। সমিতির ফান্ডে রাখা টাকায় তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি ক্যান্টিনের বাজার করেছেন। আবার ৮ লাখ টাকার এফডিআর ভেঙে ৩ লাখ টাকা সমিতির ফান্ডে জমা করে বাকি ৫ লাখ টাকা এফডিআর করেন। সমিতির ফান্ডে রাখা এই টাকায়ও তারা ক্যান্টিনের বাজার করেন। ২০১৮ সালের দিকে সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন কয়েক ভাগে ১৩ লাখ টাকা আবার এফডিআর করেন। সিটি ব্যাংক বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ শাখায় সমিতির একটি এফডিআর-এ ৮ লাখ টাকাসহ আরও একাধিক ব্যাংকে ৫ লাখ টাকার এফডিআর রয়েছে।
সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে সমিতির ব্যাংক লেনদেনে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৪১ টাকার গরমিল ধরা পড়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সংক্রান্ত অন্যান্য রেকর্ড যাচাইয়ের জন্য চাওয়া হলে ব্যবস্থাপনা কমিটি তা সরবরাহ করতে পারেনি। বিষয়টি অধিক তদন্তের দাবি রাখে। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ডিসেম্বরে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের কয়েকটি ফ্লোরে আগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সচিবালয়ের প্রবেশে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। সেসময় তদন্ত কমিটি সচিবালয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে রেকর্ডপত্র চাওয়া হলেও তারা তা ইচ্ছা করে সরবরাহ করেনি। তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানান, সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি তদন্তে মোটেই সহযোগিতা করেনি।সমবায় সমিতির ম্যানেজার মো. রুহুল আমীন বলেন, সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালক রবিউল ইসলাম কিছুদিন ক্যান্টিনের বাজার করেছেন।
বাংলাদেশ সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতিতে ধারাবাহিক লুটপাট চলছে। নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত সব পরিচালক সমানতালে তছরুপ করেছেন সমিতির অর্থ। সমিতির এক ব্যবস্থাপনা কমিটির আয়-ব্যয়ের হিসাব নেয় না পরবর্তী কমিটি। সাড়ে ৪৮ কাঠা জমি খেয়ে ফেলেছেন সমিতির সাবেক নেতারা। ক্যান্টিনে প্রতিদিন লাখ টাকার বেশি বেচাকেনা হলেও সমিতির লাভ হয় না। উলটো বকেয়া ২৯ লাখ টাকার গ্যাস বিল। বিভিন্ন পাইকারি দোকানে বকেয়া আছে কয়েক লাখ টাকা। অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত সদস্যদের নামের শেয়ার ও নম্বর বিক্রি করে ২৬ লাখ টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করেছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। খেয়ে ফেলেছেন সাড়ে ৪৮ কাঠা জমি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও গত ৫০ বছরে সমিতির কর্মচারী নিয়োগসংক্রান্ত কোনো বিধি, কাঠামো হয়নি। ৩৩ কর্মচারীর বেতন ও বোনাসের বকেয়া কয়েক লাখ টাকা। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে উঠে এসেছে আত্মসাৎ ও তছরুপের ভয়াবহ চিত্র। জানুয়ারিতে সমবায় অধিদপ্তরের রমনা থানার সমবায় কর্মকর্তা ও কেরানীগঞ্জ উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা যৌথভাবে বিষয়টি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবকিছু কমিটিগুলোর ধারাবাহিক গাফিলতির ফল। তাদের দায় এড়ানোর আইনগত কোনো সুযোগ নেই বলে কমিটির সদস্যরা মন্তব্য করেন। ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন হয়েছে তা বাতিলের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কারণ যে ভোটার তালিকার ওপর ভিত্তি করে কমিটি গঠন হয়েছে সেই তালিকা আইনসিদ্ধ ছিল না। আর্থিক লেনদেনের বার্ষিক অডিট না করাকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসাবে চিহ্ণিত করেছে তদন্ত কমিটি। বিধি অনুযায়ী না হওয়ায় দুই হাজার ৩১ জনের সদস্য পদ বাতিলের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
জানতে চাইলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন,সমিতির আয় হয় না, কর্মচারীর বেতন দিতে পারি না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় আগের কমিটি ৫০ হাজার টাকা ঋণ রেখে গেছে। ২৬ লাখ টাকা গ্যাস বিল বাকি ছিল। মাসে ২২ লাখ টাকা টার্নওভার সত্ত্বেও কেন লাভ হয় না-এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। সমিতির অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত সদস্যদের নামের প্রতিটি শেয়ার ১১০০ টাকা দরে বিক্রি করে, সর্বমোট ২৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা প্রসঙ্গে মুজিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমি কোনো টাকা নেইনি।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যাচাই করে জানা গেছে, ১৯৫৯ সালে বাংলাদেশ সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতি গঠন করেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই সমতির সদস্য পদ লাভের সুযোগ পেয়েছেন। শেয়ারমূল্য ছিল ১০ টাকা। ১৭ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুকূলে বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতর দুটি ক্যান্টিন, সচিবালয়ের বাইরে পরিকল্পনা কমিশনে একটি ক্যান্টিন বরাদ্দ দেয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সমিতির মাধ্যমে মুদি-মনিহারি পণ্য বিক্রির জন্য একটি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। সমিতির মালিকানায় বেকারি, চা স্টল, স্টেশনারি ও পান-সিগারেটের দোকানও আছে। মিষ্টি, তরল ও পাউডার দুধ এবং ফাস্টফুড বিক্রির জন্য আছে পৃথক স্টল। ক্যান্টিনগুলোর জন্য কোনো অ্যাডভান্স বা জামানত নেই। দিতে হয় না বিদ্যুৎ ও পানির বিল। শুধু গ্যাস বিল দিয়ে চালু রাখতে হয় ক্যান্টিনে রান্নার কাজ। সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার বিক্রি হয় ক্যান্টিনে। ফাস্টফুড আইটেম চলে বিকাল পর্যন্ত। এছাড়া প্রতি মাসে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে ৮০ টন চাল ও আটা বিক্রির কমিশন থেকে আয় হয় ৮০ হাজার টাকা। ক্যান্টিন, ফাস্টফুড, চায়ের স্টল ও পান-সিগারেটের দোকানে গড়ে প্রতিদিন এক লাখ থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র-শনিবার ছাড়া সপ্তাহে ৫ দিন চলে এসব দোকান।
এত সুযোগ-সুবিধার পরও সমিতি এসব ক্যান্টিন ও দোকান থেকে কোনো লাভ করতে পারছে না। বিভিন্ন পাইকারি দোকানে রয়েছে কয়েক লাখ টাকার বকেয়া। সমবায় অধিদপ্তরের রিপোর্টে বিষয়টি রহস্যজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সমিতির আর্থিক লেনদেনের বার্ষিক অডিট করা হয় না। এটাকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসাবে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। আর্থিক লেনদেনের কোনো রেকর্ডও সংরক্ষণ করা হয় না। এতে ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কমিটি নানা অজুহাতে তদন্ত কমিটিকে তথ্য ও নথিপত্র দিয়ে সহযোগিতা করেনি। ফলে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন না দিয়ে সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন দাখিল করে কমিটি।
নথিপত্র অনুসারে, সমবায় সমিতির নামে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত গাজীপুর বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পার্শ্বে ধারাইল মৌজায় ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে কেনা হয় সাড়ে ৪৮ কাঠা জমি। ওই জমি সমিতির নামে কেনা হলেও ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত যেসব নেতা দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা ওই জমি নিজেদের নামে লিখে নেন। পরে তারা প্লট করে কেউ ঘরবাড়ি তৈরি করে বংশানুক্রমে ভোগ করছেন, আবার কেউ বিক্রি করে চলে গেছেন। ৩৫ হাজার টাকা কাঠা দরে কেনা জমি বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ টাকা করে বেচাকেনা হচ্ছে। সেই হিসাবে নয় কোটি ৭০ লাখ টাকা মূল্যের সম্পত্তি গিলে ফেলেছেন সমিতির নেতারা। এমন কি সমিতি অফিসে ওই জমির একটি পর্চা ছাড়া আর কোনো দলিল, নামজারি, খাজনার রসিদ, ভায়া দলিল কিছুই নেই।পর্যায়ক্রমে যারা সমিতির দায়িত্বপালন করেছেন,কেউ এ বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান, তদন্ত বা খোঁজখবরও রাখেনি।সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি বেহাত হওয়ার পরও কমিটিগুলোর নেতারা এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি। এটা তাদের ধারাবাহিক গাফিলতি। এর দায় এড়ানোর আইনগত কোনো সুযোগ নেই বলে কমিটির সদস্যরা মন্তব্য করেন।
সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়,সমিতির একটি কমিটির মেয়াদ শেষে নতুন কমিটির কাছে হিসাবপত্র, আয়-ব্যয়, সম্পত্তির দলিল-দস্তাবেজ, রেকর্ডপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার কোনো রেওয়াজ নেই। আগের কমিটির কাছ থেকে নতুন কমিটির হিসাব বুঝে নেওয়ার কোনো নজির নেই।সমবায় সমিতি বিধিমালা অনুসারে সমিতির রেজিস্টারে সদস্যদের হালনাগাদ নাম লিপিবদ্ধ করা নেই।ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই বিধি অনুসারে নির্ধারিত শেয়ার, শেয়ারের সমপরিমাণ সঞ্চয় আমানত এবং ভর্তি ফি গ্রহণ ছাড়া এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে ২০২২ সালে ১ হাজার ২শ জন, ২০২২-২০২৩ সালে ১ হাজার ২৯ জনকে সদস্য করা হয়েছে।আইন অনুসারে না হওয়ায় তাদের সবার সদস্য পদ বাতিলের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। সমবায় আইন অনুসারে বছরে একবার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের নিয়ম রয়েছে। সাধারণ সভায় উপস্থিত সদস্যদের স্বাক্ষর সংবলিত তালিকা সমবায় অধিদপ্তরকে জানানোর নিয়ম। সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা কমিটিসহ আগের কমিটিগুলো ধারাবাহিকভাবে এই নিয়ম অমান্য করে চলছে।
২৭ বছর পর ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যে ব্যবস্থপনা কমিটি গঠন হয়েছে তা বাতিলের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কারণ যে ভোটার তালিকার ওপর ভিত্তি করে কমিটি গঠন হয়েছে সেই তালিকা আইনসিদ্ধ হয়নি। সমবায় আইন অনুসারে বার্ষিক সাধারণ সভা করে বার্ষিক আয় ও ব্যয় নির্বাহের জন্য মূলধন ও রাজস্ব বাজেট অনুমোদনের শর্ত রয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি সাধারণ সভায় অনুমোদন ছাড়া যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করেছে। ফলে গুরুতর আর্থিক বিধান লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি সম্মিলিতভাবে দায়ী এবং তাদের কাছ থেকে ব্যয়িত অর্থ আদায় করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
সমিতির ম্যানেজার মো. রুহুল আমীন বলেন, ১৯৯৩ সাল থেকে আমি প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত। এখানে কেউ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কল্যাণে কাজ করেছে বলে মনে হয়নি। সবাই আসেন আখের গোছাতে। প্রতিদিনের বাজারে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ হয়। কেউ কোনো হিসাব দেন না। ঠিকমতো ভাউচার না দিয়ে মনমতো খরচ করেন। তিনি আরও বলেন, ২৭ বছর পর ২০২৩ নির্বাচনে যে কমিটি গঠন হয়েছে। তারাই সবচেয়ে বেশি অনিয়ম করেছেন। অথচ তাদের কাছে স্বচ্ছতার প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। তিনি বলেন, সমিতির সাধারণ সম্পদকসহ অন্য পরিচালকরাও নানা ভাবে সমিতির ফান্ড তছরুপ করেছেন। সমিতির অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত সমদস্যদের নামের শেয়ার বিক্রি করে ২৬ লাখ টাকা আয় হয়েছে। প্রতি শেয়ার ১১শ টাকা করে বিক্রি করেছে। এখান থেকে একশ টাকা সমিতির ফান্ডে জমা রেখেছে। বাকি মোট ২৬ লাখ টাকা ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালকরা জনপ্রতি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা হারে ভাগ করে নিয়েছেন।
তখন বাজারের হিসাব যথাযথভাবে সংরক্ষণ কথা হতো। এতে বেশকিছু দিন ক্যান্টিনে ভালো লাভ হয়েছে। এরপর তাকে সরিয়ে দিয়ে সাধারণ সম্পাদকের পছন্দের লোকদের দিয়ে বাজার শুরু করলে সব লাভ লোকসানে পরিণত হয়। সমিতির মধ্যে একাধিক গ্রুপ হয়ে সাধারণ সদস্য এবং কর্মচারীর প্রতি অবিচার করছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। সমিতির কোষাধ্যক্ষ মো. ওসমান গনি বলেন, সমবায় আইন অনুসারে সমিতির টাকাপয়সা, আয়-ব্যয়ের সব দায়দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদকের। আমাকে একদিনের জন্যও কোনো হিসাবনিকাশ দেখানো হয়নি।