বহুল আলোচিত কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল করা হয়েছে
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: বহুল আলোচিত কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ সুযোগ দেওয়া হলেও সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত তা প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া হার্টের রিঙের ওপর আগাম কর (এআইটি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য শতাংশ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়কর ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে আগামী দিনে চিকিৎসা ব্যয় ও শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি হ্রাস পাবে। এছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ সুবিধা সর্বনিম্ন এক হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৫শ টাকা এবং পেনশনারদের ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে।
উল্লিখিত বিষয়ে পরিবর্তন এনে আগামী (২০২৫-২৬) অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। রোববার সকালে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ও সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্টকরণ অধ্যাদেশ অনুমোদিত হয়েছে। এরপর বিকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নিজ দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। এতে আগামী বাজেটের আকার দাঁড়াল ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল, যে কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বাজেট দেওয়া সহজ ছিল না। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে গেছে বা দুর্বল করা হয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়ন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। এছাড়া আমাদের সম্পদের ঘাটতিও আছে। নানা দিক বিবেচনা করে ছোট হলেও বাজেটে চমক দেওয়া হয়েছে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের আমানত বৃদ্ধি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত জাতীয় নির্বাচনের সময় এ টাকা বেশি গেছে বিদেশে। আগাম কিছুটা টের পেয়েই টাকা সরিয়েছে। কেন সুইস ব্যাংকে টাকা গেল এবং কীভাবে গেল-এ নিয়ে চিন্তা ও উদ্বেগ আছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে।দাতা সংস্থার সহায়তার প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৯০ কোটি, বিশ্বব্যাংক থেকে ৫০ কোটি, ওডিএ ১১ কোটি, জাইকা ৪১ কোটি ৬০ লাখ এবং এআইবি থেকে ৪০ কোটিসহ ২৬০ কোটি ডলার (২.৬ বিলিয়ন) সহায়তা পাওয়া গেছে। দাতা সংস্থা আমাদের প্রতি আস্থা রেখেই এসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাজেট সহায়তা হিসাবে এ প্রতিশ্রুতি মিলছে। এছাড়া প্রকল্প সহায়তা ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে।
ব্রিফিংয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, কালোটাকা সাদা করার বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি বাজেটে জমির রেজিস্ট্রেশন ফি কমানো হয়। এর ফলে জমি কেনাবেচায় সঠিক মূল্য প্রদর্শন করবেন সংশ্লিষ্টরা। জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে গেইন টেক্স গুলশান, বনানীসহ ধনিকশ্রেণির এলাকার জন্য ৮ শতাংশ প্রস্তাবিত বাজেটে থাকলেও চূড়ান্তভাবে সেটি ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া অনুন্নত এলাকার ক্ষেত্রে গেইন টেক্স প্রস্তাবিত বাজেটে ৬ ও ৪ শতাংশ থাকলেও সেটি হ্রাস করে ৩ ও ২ শতাংশ করা হয়েছে।
মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) পরিবর্তন তুলে ধরে বলা হয়, রিফাইন্ড পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর (এআইটি) ৭.৫ শতাংশের পরিবর্তে ২ শতাংশ, ঝুট থেকে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তুলার উৎপাদন পর্যায়ে এবং বিউটি পার্লারের স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বল পয়েন্ট আমদানি মূসক এবং চোখের লেন্সে আগাম কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া সব ধরনের পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৬ শতাংশ, সোলার ইনভাটার আমদানি শুল্ক ১০ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও উপকরণ রেয়াতি সুবিধায় আমদানি সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে আরও ১০টি আইটেম যুক্ত করা হয়েছে, ফলে জনগণের জন্য চিকিৎসা সেবা আরও সহজলভ্য করা যাবে।
দেশে মানসম্পন্ন টায়ার উৎপাদনের জন্য এর অন্যতম কাঁচামাল টেকনিক্যালি স্পেসিফাইড ন্যাচারাল রাবার আমদানি শুল্ক ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এদিকে আগামী বাজেটে পাবলিক ট্রেড কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর হয়েছে, সেক্ষেত্রে ওই আয়ের ওপর ২২.৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। তবে আয়বর্ষে সব ধরনের আয় ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হলে করহার ২০ শতাংশ হবে। এছাড়া অন্য সব পাবলিক ট্রেড কোম্পানির কর ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করলে করহার ২৭.৫ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশ হবে।
আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে সুপারিশকৃত ৮১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকার পরিবর্তে ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। চলতি বাজেটে ছিল ৯০ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। এছাড়া অবসরভাতা ও সঞ্চয়পত্রের সুদ সামাজিক নিরাপত্তা খাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া পেনশন ১৭,৩৮৮ টাকার ঊর্ধ্বে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং এর কমের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ বিশেষ সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ওই ব্রিফিংয়ে অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরবর্তী সময়ে রপ্তানিনির্ভর প্রণোদনা ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করতে হয়। ইতোমধ্যে দুধাপ হ্রাস করা হয়েছে এবং তৃতীয় ধাপ কার্যকর ১ জুলাইয়ের পরিবর্তে ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি করা হয়েছে।
বাজেট কাঠামো : ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৫০ হাজার কোটি টাকা।
ব্যয় : ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ১ লাখ কোটি এবং বিদেশি ঋণের সুদ ২২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হবে।
বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন : সামগ্রিক বাজেট ঘাটতির (অনুদান ব্যতীত) পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩.৬ শতাংশ এবং অনুদানসহ ঘাটতির অঙ্ক ২ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস এবং ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি এবং অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।