পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে সক্রিয় পিএসসি ও বিজি প্রেসের শক্তিশালী দুই সিন্ডিকেট
মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া:বিসিএসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে সক্রিয় পিএসসি ও বিজি প্রেসের শক্তিশালী দুই সিন্ডিকেট।তারা মিলেমিশে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।এ চক্রের সদস্যরা ছাপাখানা থেকেই হাতিয়ে নেন প্রশ্নের সব সেট। ১৭ জনকে গ্রেফতারের পর বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে সিআইডির হাতে।এসব তথ্য পর্যালোচনার পাশাপাশি দুই চক্রের যোগসূত্র এবং হোতাদের খুঁজছে তদন্ত সংস্থা। তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ চলছে। সিআইডি মনে করছে, পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফরসহ তিন কর্মকর্তাকে রিমান্ডে নিলে সিন্ডিকেটে সক্রিয় অনেক প্রভাবশালীর নাম সামনে আসবে।গ্রেফতার অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ৫ জুলাই রেলওয়ে উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার দেড় মাস আগে প্রশ্নের বিষয়ে তার কথা হয় উপপরিচালক আবু জাফরের সঙ্গে। পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে একদিন তিনি অফিসে সাজেদুলের রুমের সামনে এসে প্রশ্নের একটি খাম দিয়ে যান। সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীও জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময় বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার জন্য উপপরিচালক আবু জাফরকে দিয়ে তদবির করাতেন। ২৭তম বিসিএসে ২ জন এবং ৩৩তম বিসিএসে ৩ জনকে উত্তীর্ণ করে দেওয়া হয় তদবিরের মাধ্যমে। একেকজন প্রার্থীর কাছ থেকে এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে নিয়ে আবু জাফরকে দেওয়া হতো ৫০ হাজার টাকা। তবে উল্লিখিত ৫ প্রার্থীর নাম তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করতে চায়নি সিআইডি। আবেদ আলীর জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে প্রশ্নফাঁসে বিজি প্রেসের আলাদা সিন্ডিকেটের নাম।
পিএসসির একজন মেম্বার বলেন, যারা প্রশ্ন প্রণয়ন করেন, গোপনীয়তা রক্ষার্থে তাদের কাছ থেকে পিএসসি হাতে লেখা প্রশ্ন নেয়। প্রশ্নগুলো আসার পর পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান তার অন্য সদস্যদের নিয়ে প্রশ্ন বাছাই করেন। এরপর তা ফাইনাল হয়ে পাণ্ডুলিপি আকারে থাকে। প্রশ্ন প্রণয়নকারীরাও জানতে পারেন না তার প্রশ্ন মূল প্রশ্নপত্রে থাকবে কি না। আর মডারেশন কমিটিও কয়েক সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করে। কোন সেটে পরীক্ষাটি নেওয়া হবে, তা নির্ধারিত হয় পিএসসিতে পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক আগে লটারির মাধ্যমে। তিনি জানান, পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর কিছুদিন আগে প্রশ্নপত্রগুলো পিএসসি থেকে বিজি প্রেসে পাঠানো হয় ছাপানোর জন্য।সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতার ব্যক্তিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিতে পিএসসি এবং বিজি প্রেসের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত আলাদা দুটি সিন্ডিকেটের তথ্য পাওয়া গেছে। বিজি প্রেসের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক শহীদুল ও মোস্তফা। তাদের বিষয়ে বেশকিছু তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। ছাপানো প্রশ্নের সব সেটই এ দুই চক্রের মাধ্যমে কৌশলে ফাঁস করা হয়।জানা যায়, সাবেক কম্পোজিটর শহীদুল ইসলাম ফকির ও চাকরিচ্যুত এটিএম গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে বিজি প্রেসের ভেতরে-বাইরে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন প্রশ্নফাঁস করে আসছে এ সিন্ডিকেট। কোনো কোনো পরীক্ষায় দুই সিন্ডিকেট মিলেমিশেই ফাঁস করা প্রশ্ন বিক্রি করে। ২০১০ সালে ৮ জুলাই সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নসহ রংপুরে গোলাম মোস্তফাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ১৬৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গোলাম মোস্তফা তখন পুলিশকে জানান, বিজি প্রেসের কম্পোজিটর শহীদুলের কাছ থেকে এই প্রশ্ন সংগ্রহ করেছেন।
এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব মো. এসএম গোলাম ফারুককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে প্রশ্নফাঁসে জড়িত ১১ জনের নাম। তাদের মধ্যে বিজি প্রেসের কম্পোজিটর শহীদুল, গোলাম মোস্তফা, বাইন্ডার লাবণী বেগম, মো. হামিদুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক খন্দকার মোহাম্মদ আলী ও ফর্মা প্রুফরিডার মো. আব্দুল জলিল, সরকারী কর্ম কমিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুর রউফ এবং বহিরাগত চারজন-নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজার রহমান, আরিফ, আতিকুল ইসলাম ও মো. শাফিয়ার রহমান। কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তারা পুরোনো অপকর্ম ছাড়েননি।গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিজি প্রেসের পক্ষ থেকে প্রশ্নফাঁস বন্ধের উপায় জানতে চাওয়া হলে ২০১০ সালে গোয়েন্দা পুলিশের প্রস্তাব ছিল একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ৬১ জন পুলিশ সদস্য রাখা যেতে পারে। তারা নিরাপত্তার কাজটি করবেন। কিন্তু পরে তা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।সিআইডির আরেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পিএসসি ও বিজি প্রেসের সিন্ডিকেট নানান কৌশলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে বিক্রি করছে।
রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ৮ জুলাই সিআইডির হাতে ১৭ জন গ্রেফতার হন। এরপর পল্টন থানায় একটি মামলা হয়। ওই ঘটনায় পিএসসির ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ গ্রেফতার ব্যক্তিরা কারাগারে। গা-ঢাকা দিয়ে আছেন মামলার আসামি সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিলসহ আরও ১৪ জন। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ৬০ জনকে শনাক্তে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে সিআইডিসহ আইনপ্রয়োগকারী একাধিক সংস্থা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা বলেন, গ্রেফতার ব্যক্তিদের দেওয়া বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। পাশাপাশি পলাতকদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। যেসব তথ্য সামনে আসছে, তাও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
কেনা প্রশ্নে উত্তীর্ণ কর্মকর্তাদের তালিকা চেয়ে নোটিশ : বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নে উত্তীর্ণ হয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তালিকা প্রকাশ চেয়ে সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা ‘ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন’। ফাউন্ডেশনের পক্ষে রোববার দুই আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির পল্লব ও ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাওছার এ নোটিশ পাঠান।পিএসসির চেয়ারম্যান ও সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সচিব এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর এ লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশে ১৫ দিনের মধ্যে বিসিএস পরীক্ষায় প্রতারণার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত বিসিএস কর্মকর্তাদের নাম, ঠিকানা, বর্তমান পদবি উল্লেখপূর্বক তালিকা প্রণয়ন করে পিএসসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।