এবারের বাজেটে মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি আমলে সর্বশেষ বাজেট ছিল মাত্র ৬২ হাজার কোটি টাকার। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়েছিল ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট। সেখানে আমরা ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছি। এবারের বাজেটে মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, দেশীয় শিল্প ও সামাজিক নিরাপত্তায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো মানুষের জীবনকে উন্নত করবে। বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাছ ধরতে গেলে তো আধার দিতে হয়, আধার ছাড়া তো মাছ আসবে না।তিনি আরও বলেন, মানুষের যাতে কষ্ট না হয়। মানুষের যে চাহিদা সেটা যেন পূরণ করতে পারি, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বাজেট করেছি।শুক্রবার বিকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ছয় দফা দিবস উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা প্রশ্ন আসছে, কালোটাকা নিয়ে। কালোটাকা নিয়ে আমি শুনি-কালোটাকা সাদা করলে আর কেউ ট্যাক্স দেবে না। ঘটনা কিন্তু এটা না, এটা শুধু কালোটাকা নয়। জিনিসের দাম বেড়েছে, এখন এক কাঠা জমি যার আছে সেই কোটিপতি। কিন্তু সরকারি যে হিসাব, সেই হিসাবে কেউ জমি বিক্রি করে না। বেশি দামে বিক্রি করে, এতে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত হয়। এই টাকাটা তারা নিজেদের কাছেই রাখে। এবার আমরা চেয়েছি এমন ব্যবস্থা করতে যাতে করে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে তারা যেন সেটা আসল পথে নিয়ে আসে।
তিনি আরও বলেন,আমরা ঠাট্টা করে বলি মাছ ধরতে গেলে তো আধার দিতে হয়,দিতে হয় না?আধার ছাড়া তো মাছ আসবে না।সেই রকম একটা ব্যবস্থা,এমনটা আগেও হয়েছে।সেই তত্ত্বাবধায়ক আমলেই শুরু হয়েছিল,আর পরেও প্রত্যেক সরকারই করেছে। সেই সুযোগটা আমরাও দিয়েছি যে,অল্প টাকা দিয়ে টাকাটা আগে ব্যাংকে নিয়ে আসো। অর্থাৎ টাকাটা উদ্ধার হোক।এটা নিয়ে নানাজনে নানা কথা বলছে।
মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্যে ট্যাক্স কমিয়েছি : প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা মানুষের যা প্রয়োজন সেখানে ট্যাক্স কমিয়ে দিয়েছি। খাদ্যপণ্য, চিকিৎসাক্ষেত্রে, ক্যানসার, ডায়ালাইসিসের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, দেশীয় শিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া, ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, কাঁচামালসহ এসব বিষয়ে সুরক্ষা দিয়েছি। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাজেট দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আমি জানি কারও ভালো লাগে, কারও ভালো লাগে না। ল্যাপটপের দাম কমবে, ক্ষুদ্র-মাঝারি যন্ত্রাংশের দাম কমবে। বাজেট ঘাটতি নিয়েও অনেকে কথা বলে। আমি সরকারে আসার পর এটা ২১তম বাজেট দিলাম। সবসময় আমরা ৫ শতাংশ বাজেট ঘাটতি রাখি। এবারও ৪ দশমিক ৬ শতাংশ রাখা হয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশে এমনকি উন্নত দেশেও আছে। সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমরা এখনো উৎপাদনমুখী হলে খাদ্যে কোনোদিন অভাব হবে না।
গ্রামের মানুষের মাঝেও সচ্ছলতা দেখা দিয়েছে : প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে কাজ করেছি বলেই বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। আজ গ্রাম পর্যায়ের মানুষের মাঝেও আর্থিক সচ্ছলতা দেখা দিয়েছে। আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ ভাগের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলাম।মাথাপিছু আয় বাড়িয়েছি। ১৯৯৬ সালে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করি। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শুরু করি। ২০০১ সালে আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। কারণ গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি, এটাই ছিল আমার অপরাধ। তিনি বলেন, এরপর দেশটা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বাংলা ভাই ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কোভিড দেখা দিল। এর মধ্যেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। গম, তেল, জ্বালানি, গ্যাসসহ অনেক কিছু আমাদের বাহির থেকে আনতে হয়। রিজার্ভ কত আছে, সেটা বিবেচনার বিষয় না, আমাদের মানুষকে খাওয়াতে হবে আগে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা পানির মতো টাকা খরচ করেছি।
আমাদের তেল মারা গোষ্ঠীর দরকার নেই : প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কারও কাছে হাত পেতে চলব না। ভিক্ষা করব না। এটাই আমাদের নীতি। আমাদের দেশে ‘ভালো না-লাগা গ্রুপ’ আছে। যখন কোনো অস্বাভাবিক সরকার আসে তারা খুব খুশি হয়। কারণ তখন নাকি তাদের গুরুত্ব থাকে। আর মানুষের ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাদের নাকি মূল্যায়ন হয় না। মূল্যায়নটা করব কীভাবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তো দেখেছি তারা অগণতান্ত্রিক সরকারকে কীভাবে তেল মারে। আমাদের ওই তেল মারা গোষ্ঠীর দরকার নেই।
অনেক জায়গায় অনেকে খেলা খেলতে চেষ্টা করেছে : শেখ হাসিনা বলেন, অনেক জায়গায় অনেকে খেলা খেলতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু জনগণ আমাদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন। তাদের ভোটেই আমরা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছি।
‘ইতিহাসের গতিধারায় বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’ শীর্ষক সংবাদচিত্র : এর আগে সভার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সংগঠনের কার্যালয়ে ফিতা কেটে ‘ইতিহাসের গতিধারায় বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’ শীর্ষক সংবাদচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন এবং পরিদর্শন করেন। আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শাজাহান খান, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃনাল কান্তি দাস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সবুর, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পনিরুজ্জামান তরুণ। সভা সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুল আউয়াল শামীম।
নির্বাচনটাই যেন না হয় সেজন্য অনেক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ছিল : এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় গণভবনে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভার সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে বদলে গেছে, সেটা ধরে রেখেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। সেক্ষেত্রে আপনাদের পরামর্শ, আপনাদের বক্তব্য এগুলো জানা দরকার। আগের মতো ঘন ঘন মিটিং করা এখন আর সম্ভব হয় না। কারণ এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের দিয়ে একটি টিম গঠন করে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। ওই টিমের সদস্যসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের আস্থা-বিশ্বাস আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। সেটাই আমাদের বড় শক্তি। কারণ নির্বাচনটাই যেন না হয় সেজন্য অনেক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ছিল। সেজন্য বিরোধী দল নির্বাচনে আসবে না। কারণ তারা জানত নির্বাচন তো হবেই না। কাজেই ইলেকশনে আসবে না।
নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে একটা চক্রান্ত ছিল : শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে একটা চক্রান্ত ছিল। এগুলো আমরা কিছুটা বুঝতে পারি। যার জন্য আমরা এবার একটা রিস্ক নিয়েছিলাম। আমি নির্বাচনটা ওপেন করে দিয়েছিলাম। আমি নমিনেশন দিলাম সত্য, কিন্তু সে সঙ্গে ওপেন করে দিয়ে বললাম, যে যত পার দাঁড়াতে পার। হয়তো এমন হতে পারত, যারা দাঁড়িয়েছে তারাই বেশি আসন পেল, আমরা পার্টিগতভাবে কম পেলাম। কিন্তু সেটা হয়নি। তবে এই ওপেন করে দেওয়াতে যেটা হয়েছে তা হলো ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা এককভাবে ২৩৩টা আসন পেয়েছিলাম, এবার ২২৩টা পেয়েছি। কারণ আমাদের স্বতন্ত্র অনেকেই জয়ী হয়ে এসেছেন।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্যের পর তার সভাপতিত্বে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যরা ছাড়াও দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন।দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় ও টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের পর প্রথমবারের মতো দলের থিংকট্যাংক হিসাবে পরিচিত উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যদের বৈঠকে ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।বৈঠকে উপদেষ্টা পরিষদের নেতারা টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানান। একই সঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত নতুন বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাজেটের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলেও আশা ব্যক্ত করেন তারা।
বৈঠকে দলের উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন নেতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে জনজীবনে সৃষ্ট সংকট দ্রুত নিরসনের তাগিদ দেন। তারা বলেন, এসব কারণে সরকারের উন্নয়ন ও অর্জন কিছুটা হলেও ম্লান হচ্ছে। জনমনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে জানিয়ে এটা দূর করার কার্যকর তাগিদও দিয়েছেন।২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। উপদেষ্টাদের বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের বিষয়টি আলোচনা হয়েছে।সভায় জানানো হয়, এবার প্লাটিনাম জয়ন্তী বর্ণাঢ্য ও ব্যাপকভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০ দফা কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের নেতারাও এ বিষয়ে নানা পরামর্শ তুলে ধরেন। এছাড়া বিএনপিসহ বিরোধীদের কর্মকাণ্ড, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং সমসাময়িক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়েও নানা মত তুলে ধরেন নেতারা।