প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পেয়েছে দুদক
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :খাদ্য অধিদপ্তরে উপখাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির একটি ইউনিট গোপন তদন্তে প্রশ্নফাঁসের সত্যতা পাওয়ার পর সরাসরি মামলা কিংবা অনুসন্ধানের সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে, প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে প্রকাশ্যে অনুসন্ধান ও বিতর্কিত নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অথবা অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ স্থগিত রাখতে কমিশন থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ারও সুপারিশ রয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পরই নিয়োগ স্থগিত রাখতে খাদ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় কমিশন। এরপরই বিতর্কিত এই নিয়োগ নির্বিঘ্ন করতে দুদকে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন খাদ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ‘এই নিয়োগ সম্পন্ন করা প্রধানমন্ত্রীর ডিজায়ার’-এমন কথা বলে তারা কমিশনকে চাপ দিয়ে দুদকের স্থগিত সংক্রান্ত চিঠি প্রত্যাহারের অপচেষ্টা করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।দুদকে অভিযোগকারী চাকরিপ্রার্থী রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দুদকের পক্ষ থেকে নিয়োগ স্থগিত করতে বললেও লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে মৌখিক পরীক্ষা। এখন নিয়োগ চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। দুদক যে ক্ষমতাহীন, এটা তার প্রমাণ। তাহলে ঝুঁকি নিয়ে টাকা খরচ করে প্রশ্নফাঁসের তথ্যপ্রমাণ দুদককে দিয়ে কী লাভ হলো। নিয়োগে মোটা টাকার লেনদেন জায়েজ করতেই খাদ্য অধিদপ্তর দুদককে ম্যানেজ করে নিয়োগ সম্পন্ন করতে চাচ্ছে। এমন হলে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা একটুও থাকবে না।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। তাই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. শাখাওয়াত হোসেন দুদকের স্থগিতাদেশের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আমরা লিখিতভাবে দুদককে দুই দফা চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছি। প্রথম চিঠি দেওয়া হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয় দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছে দুই দিন আগে। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা এখনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। দুদক স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলে আমরা নিয়োগ চূড়ান্ত করব। আর তা না হলে পুনায় উপখাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লোক নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিয়োগ সম্পন্ন করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ডিজায়ার-এমন কথা বলে কেউ চাপ সৃষ্টি করেছে কি না, তা আমার জানা নেই।জানা যায়, ২০১৮ সালের ২১ জুলাই খাদ্য অধিদপ্তরে ২৪ ক্যাটাগরির ১ হাজার ১১৬টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে ২৫০টি উপখাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর। এই পদে ৪ লাখ ১১ হাজার ৭৯৮ জন চাকরিপ্রত্যাশী পরীক্ষায় অংশ নেন। প্রতি পদের বিপরীতে লড়াই করেন ১ হাজার ৬৪৭ জন প্রার্থী। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং তাদের পরীক্ষাকেন্দ্রে আসা-যাওয়ার কথা বিবেচনা করে ২৮টি জেলায় কেন্দ্র স্থাপন করে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করে খাদ্য অধিদপ্তর। প্রশ্নপত্র প্রেরণের কারিগরি সহায়তার জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি। কিন্তু পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। অনেক পরীক্ষার্থী দুদকের টোল ফ্রি হললাইন নম্বরে (১০৬) কল করে এবং ই-মেইলে বার্তা পাঠিয়ে প্রশ্নফাঁস নিয়ে তাদের ক্ষোভের কথা জানান। এ নিয়ে তখন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার ও প্রকাশিত হয়। এসবের সূত্র ধরে গোপন তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর দুদক প্রধান কার্যালয়ের একটি ইউনিটের নথির বলে ঘটনার গোপন তদন্তের জন্য দুই সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়। দুদকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এই টিম অভিযান চালায়। অভিযানকালে তারা অভিযোগসংশ্লিষ্ট খাদ্য অধিদপ্তর, বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেন। একই সঙ্গে দুদক কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় নথি ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট কার্যালয়গুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এতে তারা জানতে পারেন, বুয়েটের দুজন এক্সপার্টের সহায়তা নিয়ে ২৮টি জেলায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রশ্নপত্র প্রেরণ করা হয়। ডোঙ্গল পদ্ধতিতে প্রেরিত ওই প্রশ্নপত্র জেলা প্রশাসক ও ডিসি (ফুড) তাদের কাছে পাঠানো যৌথ পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে ডাউনলোড করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থাপন করা প্রিন্টারের মাধ্যমে প্রশ্ন প্রিন্ট করার পর কেন্দ্র অনুযায়ী ভাগ করে সেগুলো সিলগালা করে রাখা হয়। পরদিন প্রশ্নপত্রের প্যাকেট কেন্দ্রে পাঠিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু পরীক্ষার আগের রাতেই একাধিক জেলা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে।
অভিযানকালে দুদক কর্মকর্তারা পরীক্ষার আগের রাতে জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তির ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করা প্রশ্ন সংগ্রহ করে। এই প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার সময় সরবরাহ করা প্রশ্নের শতভাগ মিল পাওয়া যায়। অভিযানে প্রশ্নপত্র প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর প্রতিবেদন দেয় দুই সদস্যের টিম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরীক্ষার আগের দিন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রশ্ন ডাউনলোডের পর সিলগালা করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সময় প্রশ্ন প্রিন্টিং কাজে ব্যবহার করা হয়। ওই সময় ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তখন ওই কাজে অনেকেই নিয়োজিত ছিল। তাদের কারও কারও মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা প্রবল মর্মে প্রতীয়মান হয়। যেসব জেলায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, সেসব জেলায় যারা প্রশ্ন প্রণয়ন ও প্রিন্টিং কাজে জড়িত ছিলেন, তাদের মোবাইল সিডিআর এনালাইসিসসহ মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়া লিংক এবং গণমাধ্যমে দেখানো বিকাশ নম্বরে ব্যবহৃত ডিভাইস জব্দ করে ডিজিটাল ফরেনসিক করলে জড়িতদের চিহ্নিত করা যাবে।প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, যেহেতু আগের রাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র এবং মূল পরীক্ষার প্রশ্নে শতভাগ মিল পাওয়া যায়, সেহেতু এই নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা যেতে পারে। অথবা অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত রাখা যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় কে কে জড়িত, তা উদ্ঘাটনের জন্য ধারা উল্লেখ করে সরাসরি মামলা দায়ের বা প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করা যেতে পারে।জানা যায়, এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর চলতি বছরে অনুষ্ঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির ৩০৩ নম্বর নথির বরাতে অভিযানে প্রাপ্ত তথ্য সঠিক মর্মে কমিশন থেকে নিয়োগ স্থগিত রাখতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে রহস্যজনক কারণে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত না নিয়ে নথিটি সাত মাস ধরে ফেলে রেখেছে দুদক। এ অবস্থায় খাদ্য অধিদপ্তরের ‘নিয়োগ সিন্ডিকেট’ ফাঁস হওয়া প্রশ্নে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমেই নিয়োগ সম্পন্ন করতে দুদক থেকে অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টা করছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুদক স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে চিঠি দিতে পারে।সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে গত ১০ আগস্ট দুদক কার্যালয়ে তিন পক্ষের আনুষ্ঠানিক শুনানি হয়েছে। শুনানিতে কমিশনের চেয়ারম্যান, খাদ্য অধিদপ্তরের ডিজি ও তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন। শুনানিতে এক কর্মকর্তা ‘নিয়োগ সম্পন্ন করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ডিজায়ার’-বলে মন্তব্য করেন। এ সময় তদন্ত কর্মকর্তাদেরও নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়।