ক্লাসের চাপে নাকাল স্নাতক পর্যায়ের কলেজ শিক্ষকরা
মু এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া :ক্লাসের চাপে নাকাল স্নাতক পর্যায়ের কলেজ শিক্ষকরা। একজন শিক্ষককে সপ্তাহে ২০-২২টি ক্লাস নিতে হচ্ছে। যেসব কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর আছে সেখানে চাপ আরও বেশি।এছাড়া পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি, অভ্যন্তরীণ, বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরপত্র মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীদের পরামর্শদান, ল্যাবরেটরিতে কাজসহ আনুষঙ্গিক অনেক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।ক্ষেত্র বিশেষে কাউকে প্রশাসনিক কাজও করতে হয়। সব মিলে কাজের চাপে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় গ্রাম পর্যায়ের কলেজেও অনার্স-ডিগ্রি স্তর চালু করে দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।সংশ্লিষ্টদের মতে, চাপের প্রধান কারণ শিক্ষক সংকট। সরকারি কলেজে নিয়মিত বিসিএসের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয় না। জাতীয়করণ করা কলেজে নিয়োগ-পদায়ন বন্ধ। বেসরকারি কলেজে কোথাও আর্থিক কারণে নিয়োগ হয় না।
এজন্য ভুগতে হচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা অতিরিক্ত ক্লাস নিচ্ছেন। জনবল কাঠামো অনুযায়ী শিক্ষক এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী ‘ওয়ার্কলোড’ বণ্টন করে দেওয়া হলে সংকটের অবসান হবে বলে মনে করেন তারা। কলেজ পর্যায়ের উচ্চশিক্ষার একাডেমিক দিক দেখভাল করে থাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয়। ২ আগস্ট এ প্রসঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমানের সঙ্গে কথা হয়।তিনি বলেন, ‘অনার্স ও মাস্টার্স স্তর চালুর ক্ষেত্রে আমরা একটা জনবল কাঠামো অনুসরণ করে থাকি। ন্যূনতম ১২ জন শিক্ষক না থাকলে কলেজের কোনো বিভাগে মাস্টার স্তর অনুমোদন দেওয়া হয় না। একটি কলেজে যদি ডিগ্রি বা অনার্স থাকে আর শিক্ষক কাঠামো নিশ্চিত করা হয়, তবে তাদের ক্লাসের চাপে ভারাক্রান্ত হওয়ার কথা নয়।তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত কোনো ওয়ার্কলোড ব্যবস্থাপনা করে দেওয়া নেই। প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষকের ক্লাস বণ্টনের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) একটা নীতি আছে, যা কলেজগুলো অনুসরণ করে থাকে।এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় সাড়ে ১৭শ কলেজে ডিগ্রি, অনার্স ও মাস্টার্স স্তর আছে। যার মধ্যে প্রায় ২শ মাস্টার্স আর ৮শ অনার্স কলেজ। বাকিগুলোতে শুধু ডিগ্রি পর্যায়ের পাঠদান করা হয়ে থাকে।আবার ইডেনের মতো হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, যে বিভাগে মাস্টার স্তর আছে সেখানে ১২ জন আর অনার্স থাকলে ৭ জন শিক্ষক থাকতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিকসহ ডিগ্রি কলেজে প্রতি বিষয়ে ৩ জন করে শিক্ষক থাকতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উল্লিখিত নিয়ম বাস্তবায়িত হলে শিক্ষকদের ক্লাসের চাপে পড়তে হতো না। কিন্তু খুব কম কলেজে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক আছে। গত মে মাসের হিসাব অনুযায়ী, ৩ শতাধিক সরকারি কলেজ ২২৮৯টি পদ শূন্য আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট পদ আছে ১৫ হাজার ৯৫১টি। অধ্যাপক থেকে বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতি, অবসর, মৃত্যু ও পদত্যাগজনিত কারণে গড়ে প্রতিবছর ৪৫-৫০টি পদ শূন্য হচ্ছে। এটা সহসা পূরণ হয় না।একেকটি বিসিএস শেষ করতে প্রায় ২ বছর লেগে যায়। ফলে গড়ে দেড়-দুই হাজার প্রভাষকের পদ সব সময়ই খালি থাকে। এছাড়া নিয়মিত পদোন্নতি না হওয়ায় অধ্যাপকসহ বাকি তিন স্তরেও পদ শূন্য থাকে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন কলেজ থেকে পদের শূন্যতার তথ্য জানিয়ে মাউশিতে চিঠি পাঠান অধ্যক্ষরা। কিন্তু এর সুরাহা হয় না। কেননা অনেকেই মফস্বলে গিয়ে চাকরি করতে চান না।
সরকারি শূন্য পদের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে মাউশির এক কর্মকর্তা বলেন, পাংশা সরকারি কলেজে বিভিন্ন বিষয় বা বিভাগভিত্তিক সৃষ্টপদ ৫৬টি। কিন্তু গত ৩০ জুনের হিসাব অনুযায়ী আট শিক্ষক দিয়ে চলছে পাঠদান।এ কলেজে এইচএসসি, ডিগ্রি, অনার্স এবং মাস্টার্সে প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। গত ৭ আগস্টের তথ্য অনুযায়ী, বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের ৪৯টি শিক্ষক পদের মধ্যে ২০টিই শূন্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে দশ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আছে।কলারোয়া সরকারি কলেজে বিভিন্ন স্তরে ১৬টি শিক্ষকের পদ শূন্য। এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। একইচিত্র দেশের প্রায় সব সরকারি কলেজের।অন্যদিকে দেশে প্রায় সাড়ে ৩শ বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করেছে সরকার। কিন্তু এ সংক্রান্ত কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে বেসরকারি নিয়োগ বন্ধ আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবেও তেমন একটা পদায়ন হয় না।
এমনকি অনেক কলেজে অধ্যক্ষের পদও শূন্য। বিপরীত দিকে প্রায় প্রতিদিনই এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকরা অবসরে যাচ্ছেন। এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বরগুনার আমতলী সরকারি কলেজ। ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল জাতীয়করণ হয়।প্রতিষ্ঠানটিতে স্নাতক ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ২৭৩৬ জন ছাত্রছাত্রী আছে। ২২টি বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এর মধ্যে ৮টি বিষয়েই শিক্ষক নেই। ফলে এসব বিষয়ে পাঠদান বন্ধ আছে। এছাড়া জাতীয়করণ হওয়ার পর বাকি বিষয়ের অনেক শিক্ষক অবসরে যান।সব মিলে কলেজটিতে বর্তমানে চরম শিক্ষক সংকট রয়েছে। এমনকি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।শিক্ষক ঘাটতি আছে বেসরকারি কলেজেও। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১৬ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য। মফস্বলে আর্থিক অবস্থার কারণে ডেকেও শিক্ষক পায় না অনেক কলেজ।
এই অবস্থার মধ্যে আবার গ্রাম পর্যায়েও কলেজে অনার্স-ডিগ্রি স্তর চালু করে দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া অভিযোগ আছে, যথাযথ পরিদর্শন ছাড়াই কলেজে অনার্স-মাস্টার্স অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজ শিক্ষক পরিষদের সভাপতি নেকবর হোসাইন বলেন, সরকার এমপিও দেয় না। ঢাকাসহ বড় শহরের এ ধরনের কিছু কলেজে শিক্ষকদের নিজস্ব তহবিল থেকে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়।কিন্তু মফস্বলের বেশিরভাগ কলেজে সেই সামর্থ্য নেই। নামমাত্র যা দেওয়া হয় এতে অনেকে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। আর সমাজে পরিচয় দেওয়ার জন্য যারা টিকে আছেন, ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এই অবস্থায় অনার্স বা মাস্টার্স পাঠদান কী হয় তা সহজেই অনুমেয়।
ক্লাস বণ্টনে আছে সমাধান : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান শিক্ষক দিয়েই ক্লাসের চাপের সমাধান সম্ভব। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বণ্টনের ক্ষেত্রে একটি প্রথা চালু আছে। সে অনুযায়ী, একজন অধ্যাপক সপ্তাহে ১০টি ক্লাস নেন।এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক ১২টি, সহকারীরা ১৪টি আর প্রভাষকরা ১৬টি ক্লাস নেন। তবে কোনো বিভাগে যদি শিক্ষক কম থাকে এবং কোর্স অনুযায়ী ক্লাস সংখ্যা বেশি হয়ে যায় তখন আনুপাতিক হারে তা জুনিয়র থেকে সিনিয়রদের বণ্টন করা হয়।এরপরও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের টিচিং লোড ক্যালকুলেশন নীতিমালা, ২০২২’ প্রণয়ন করছে। প্রস্তাবিত ওই নীতিমালায় প্রত্যেক শিক্ষকের সপ্তাহে অন্তত ৪০ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকার বলেন, ক্লাস বণ্টনের ক্ষেত্রে এই নিয়ম সিন্ডিকেট পাশ করে দিয়েছে যা বিভাগগুলো অনুসরণ করে থাকে।
অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকরা যেহেতু এমফিল ও পিএইচডি গবেষকদের ‘সুপারভাইজ’ করেন, তাই তাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্লাস কম দেওয়া হয়। তবে কর্মঘণ্টার হিসাবে তাদের পরিশ্রম বেশিই করা হয়ে থাকে। কেননা গবেষকদের অনেক সময় দিতে হয় তাদের।কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের ক্ষেত্রে অবশ্য এমন কোনো নিয়ম নেই বলে ২ আগস্ট নিশ্চিত করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান। তবে সরকারি কলেজে মাউশি দীর্ঘদিন একটি চর্চা করেছে। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তেমন কিছু নেই। তবে মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বৃহস্পতিবার বলেন, ক্লাস বণ্টনের জন্য কলেজে কোনো লিখিত নিয়ম আছে কিনা সেটা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলতে পারবে। তবে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা বহুদিন ধরে একটি রীতি অনুসরণ করে থাকেন। সেটি অনুসারে প্রভাষকরা সপ্তাহে ২৪টি ক্লাস নেন। এছাড়া সহকারীরা ১৮টি, সহযোগীরা ১৬টি আর অধ্যাপক ১২টি করে ক্লাস নেন। এছাড়া অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষদের সপ্তাহে অন্তত দুটি করে ক্লাস নেওয়ার কথা আছে।