দুর্নীতি ও ক্ষুধামুক্ত বৈষম্যহীন কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমীর, মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই বলেছেন, একটি অপশক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে কৃত্রিমভাবে উপস্থাপন করে বৈশ্বিক হানাদার শক্তির দৃষ্টি আকর্ষণের অপচেষ্টা চালাচ্ছে।ঘাদানিকের শ্বেতপত্রকে “গণনাগরিক অবমাননা” অবহিত করে পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, কথিত শ্বেতপত্র নিয়ে তাদের একধরণের রাখঢাক-লুকোচুরি ও মিডিয়াবাজি প্রমাণ করে যে, তারা সারবত্তাহীন অভিযোগ পত্র নিয়ে নাগরিকদের মাঝে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। এধরণের দেশ ও ইসলামবিরোধী কর্মকান্ড রুখে দিতে হবে।তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫১ তম বর্ষে এসেও আজকের সরকার ৭১ পুর্ববর্তী সরকারের মতো, নিপিড়নমূলক আচরণ করছে। দেশের সাধারণ নাগরিকদের কোন অধিকার ও সম্মান নেই। সকল অধিকার ভোগ করছে ক্ষমতাসীন এবং তাদের দোসররা। অথচ স্বাধীনতা উত্তর দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল, স্বাধীন দেশে তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে। স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মর্যাদা পাবে, সম্মান পাবে। বাক স্বাধীনতা পাবে, ন্যায়বিচার পাবে। জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর এবং জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। অর্থনৈতিক সাম্য ও রুটি রুজির নিশ্চয়তা পাবে। একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পাবে।তিনি বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী যারাই ক্ষমতায় এসেছে, সবাই জনগণের স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করেছে। সবাই জনগণের সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। গণ-মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। দেশ শাসনের নামে জনগণকে জিম্মি করে রেখেছে। জনগণের সকল মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। জনগণের সম্পদ লুন্ঠন করেছে। গণতন্ত্রের নামে সর্বত্র দলীয়করণ এবং স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। গুম ও খুনের রাজত্ব কায়েম করেছে। দুর্নীতি, লুটপাট এবং সুদ ও ঘুষকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। শাসক শ্রেণীর এহেন কর্মকান্ডের ফলে স্বাধীনতা আজ অর্থহীন হয়ে পড়েছে। গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি দেশে একধরণের দুর্ভিক্ষ জন্ম দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যাচ্ছে। খাবারের জন্য খাদ্য ট্রাকের পেছনে মানুষ দৌড়াচ্ছে। জাতিকে নেশাগ্রস্থ করে স্বার্থ হাসিলের পায়তারা চলছে। দেশ আর এভাবে চলতে পারে না।শুক্রবার বাদ জুম’আ বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে (বেলস্ পার্ক) অনুষ্ঠিত স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমূদ্রে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কথিত ‘গণকমিশন’ কর্তৃক দেশের সম্মানিত ১১৬ জন আলেম ও ১০০০ মাদরাসার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং ইসলাম ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের প্রতিবাদ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ, শিক্ষা-সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষার সংকোচন বন্ধ, ইসলাম, দেশ ও মানবতাবিরোধী মদের বিধিমালা বাতিল, স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে ইসলামী হুকুমত কায়েমের লক্ষ্যে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বরিশাল বিভাগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে চরমোনাই পীর এ সব কথা বলেন।সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন দলের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম শায়খে চরমোনাই। বাদ জুম’আ সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও জুম’আর আগেই বরিশাল বঙ্গবন্ধু উদ্যান ও আশপাশের এলাকা লোকে লোকারন্য হয়ে যায়। বিকেল ৪.৩০মি. যখন দলের আমীল বক্তব্য রাখেন সমাবেশ স্থলে তিল ধারণের ঠাই ছিল না।সমাবেশের কারণে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা যানশূণ্য হয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের দখলে চলে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই দাম বাড়ে বলে মন্ত্রণালায়ের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। সরকারীদলের সমর্থনপুষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীরা স্তরে স্তরে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করে। পথে-ঘাটে পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানরা চাঁদাবাজি করে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানী করার ক্ষেত্রে সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা নানা ধরণের কারসাজী করে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে।সরকারের ভুল মুদ্রানীতি, শুল্কনীতি, আমদানী সিদ্ধান্তে অপরিণামদর্শিতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সিন্ডিকেটবাজী বন্ধ করতে আইন-শৃংখলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যবসায়ীদের দৌরত্ব কমাতে হবে। যেকোন মূল্যে খাদ্যদ্রব্যের দাম সহনীয় করতে হবে। মাদক প্রসঙ্গে তিনি কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। রাসুলুলস্নাহ (সা.) বলেন,
আল্লাহর অভিশাপ মদের ওপর, তা পানকারীর ওপর, যে পান করায় তার ওপর, যে বিক্রি করে তার ওপর, যে তা নিষ্কাসন করে এবং যারআদেশে নিষ্কাসন করে তার ওপর আর যে ব্যক্তি তা বহন করে এবং যার কাছে পৌঁছে দেয়, সবার ওপর।’ (সুনানে আবি দাউদ) “অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২২” নামক মদ সহায়ক একটি বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। সরকার দেশে মদ ও অ্যালকোহল আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সরবরাহ, বিপণন ও ক্রয় বিক্রয় এবং সংরক্ষণের দুয়ার উন্মুক্ত করতে চাইছে। মদকে একটি সাধারণ ও সহজলভ্য পানীয় বানিয়ে ফেলা হয়েছে।যার মাধ্যমে গোটা দেশের তরম্নণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিন প্রসঙ্গে পীর সাহেব বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে এইচএসসি পরীক্ষার আবশ্যিক বিষয়াবলী থেকে ইসলাম শিক্ষাকে বাদ দেয়া হয়েছে। মানবিক বিভাগ ছাড়া বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও অন্যান্য বিভাগে ইসলাম শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয়েও রাখা হয় নাই। ফলে শিক্ষার্থীরা ইসলাম শিক্ষার আগ্রহ হারাচ্ছে। মাধ্যমিক স্তরে যতটুকু ইসলাম শিক্ষা রাখা হয়েছে তাতেও ইসলামকে খন্ডিত আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আর উচ্চশিক্ষায় ইসলাম শিক্ষা সম্পূর্ণই বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মেধাবীরা দেশের জন্য সম্পদে পরিণত না হয়ে দেশের জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠছে। বুয়েটে পড়েও কিছু ছেলে খুনিতে পরিণত হয়েছে। সর্বোচ্চ মেধার স্বাক্ষর রাখা মেধাবীরাই প্রশাসনে গিয়ে দুর্নীতি করে দেশের উন্নয়ন ও বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করছে। তিনি শিক্ষার সকল স্তরেই ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান।
চরমোনাই পীরের ১৫ দফা দাবীগুলো হলো-১. যেকোন মূল্যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি রোধ করতে হবে।বাজার কারসাজীর সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ২. দেশে মদ ও সকল ধরণের মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ করতে হবে। ৩. শিক্ষার সকল স্তরে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। পূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গণ্য করতে হবে। ৪. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুসলিম শিশুদের জন্য নামাজ শিক্ষা ও কোরআন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। ৫. শিক্ষা সিলেবাস থেকে চরম নাস্তিকক্যবাদী সকল ধর্মবিরোধী, অবৈজ্ঞানিক ও বস্তাপঁচা ডারউইনের থিউরি বাদ দিতে হবে। কারান্তরীণ সকল মজলুম আলেম এবং রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। ৬. জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। ৮. সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। ৯. তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং নির্বাচনের দিন সশস্ত্রবাহিনীর হাতে বিচারিক ক্ষমতা দিতে হবে। ১০.নির্বাচনে সকল দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। রেডিও, টিভিসহ সকল সরকারি বেসরকারি গণমাধ্যমে সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে এবং রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে সকল ধরণের হয়রানী বন্ধ করতে হবে। ১১. দুর্নীতিবাজদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। ১২. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে। ১৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জাতীয় সংহতি ও কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির (চ.জ) নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। ১৪. গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে ১৫.সকল রাজনৈতিক দলের জন্যে সভা-সমাবেশসহ সাংবিধানিক স্বীকৃত সকল রাজনৈতিক কর্মসূচি ও বাকস্বাধীনতা উন্মুক্ত করতে হবে।
এ সময় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন দলের মহাসচিব হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, কেন্দ্রীয় দাওয়াহ বিষয়ক উপদেষ্টা প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুব, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক বেলায়েত হোসেন, কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক মাওলানা লোকমান হোসাইন জাফরী, সহ অর্থ-সম্পাদক মাওলানা নূরুল ইসলাম আল আমীন, ইসলামী যুব আন্দোলন সেক্রেটারী জেনারেল আতিকুর রহমান মুজাহিদ, ইসলামী শ্রমিক আন্দোলনের সেক্রেটারী জেনারেল হাফেজ মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরুল করীম আকরাম, চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুফতী সৈয়দ জিয়াউল করীম, বরিশাল সদর জাগুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুফতী হেদায়েতুল্লাহ আজাদী, বাকেরগঞ্জ নিয়ামতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুহাম্মাদ হুমায়ুন কবির সহ বিভাগীয় জেলা মহানগর নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক উপাধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম।