ফেঁসে যাচ্ছেন সেই চিফ ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল,দুদকের ফাঁদ টিম ব্যবহারের মূলহোতা - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ফেঁসে যাচ্ছেন সেই চিফ ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল,দুদকের ফাঁদ টিম ব্যবহারের মূলহোতা


আলোকিত বার্তা:নাম এসএম নাজমুল হক।নৌপরিবহন অধিদফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার।ঘুষের ৫ লাখ টাকাসহ দুদকের হাতে গ্রেফতারের পর সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন তিনি। দুই দফায় জেলও খাটেন ৮ মাস। গুরুতর এই অপরাধে চাকরিতে ফেরা তার অনিশ্চিত।কিন্তু চাকরি গেলেও শেষরক্ষা হচ্ছে না।ইতোমধ্যে দুদকের অনুসন্ধানে তার বিপুল পরিমাণ আয়বহির্ভূত সম্পদের ফিরিস্তি ধরা পড়েছে।হয়েছে মামলাও।এখন চার্জশিট হওয়ার পথে।তবে দীর্ঘ অনুসন্ধানে তার নামে-বেনামে আরও সম্পদের সন্ধান মিলেছে প্রসঙ্গত, নৌপরিবহন অধিদফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার থাকাবস্থায় ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সেগুন রেস্তোরাঁয় ঘুষের ৫ লাখ টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার হন নাজমুল হক। মেসার্স শিপিং মাইন্ডের নকশা ও জাহাজ অনুমোদনের জন্য ১৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবির অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ঘুষের দ্বিতীয় কিস্তি নেয়ার সময়ই দুদক তাকে গ্রেফতার করে। এরপর দুদক টিম তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এরপর তিনি দু’দফায় ৮ মাস কারাবাসের পর জামিন পান। কিন্তু প্রভাবশালী বিভিন্ন মহলকে নানাভাবে ব্যবহার করে তিনি একরকম ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। তবে সম্প্রতি তার মামলায় গতি ফিরেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, এসএম নাজমুল হক জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যাতে তার পদে সম্ভাব্য কেউ না আসতে পারে সেজন্য দুদকের ফাঁদ টিমের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ঘৃণিত পথ বেছে নেন। মীর্জা সাইফুর রহমান নামে নৌপরিবহন অধিদফতরের এক সিনিয়র কর্মকর্তার পদোন্নতি ঠেকাতে তিনি প্রস্তুতি অনুযায়ী একটি ফাঁদ টিমকে বশে আনতে সক্ষম হন। যথারীতি ঘুষের টাকার নাটক সাজিয়ে শিপ সার্ভেয়ার মীর্জা সাইফুর রহমানকে ধরিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মচারীর সঙ্গে ফোনালাপে মীর্জা সাইফুর রহমানকে ধরিয়ে দেয়ার নীলনকশা সবিস্তারে খুলে বলেন। যার রেকর্ড হাতে চলে আসে। ‘দুদকে সাজানো ফাঁদে কর্মকর্তার সর্বনাশ’ শিরোনামে এ বিষয়ে ১৫ জুন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই রেকর্ডে নাজমুল হককে বলতে শোনা যায়, ‘ক্যাপ্টেন গিয়াস, মঞ্জুর, ফখরুলসহ চারজন এক হয়ে মীর্জাকে (শিপ সার্ভেয়ার মীর্জা সাইফুর রহমান) ধরিয়েছি। কে কত টাকা দিয়েছে, কে কী কাজ করেছে, আমার কাছে তো সব রেকর্ড আছে। মীর্জাকে ধরার পেছনে আমি আছি। ট্র্যাপ কেসে কাউরে ধরানো কোনো ব্যাপার না। চারজন সমানভাবে ফাইন্যান্স করেছি। বিনা টাকায় কি দুদক আইসা ধইরা নিয়ে যায়?’ এই রিপোর্ট প্রকাশের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। একই সঙ্গে যারা বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নাজমুল হককে রক্ষা করার অপচেষ্টা করে আসছিলেন, তারাও রাতারাতি নিজেদের গুটিয়ে ফেলেন।সূত্র জানায়, গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান থেকে এ বিষয়ে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে গত মাসের শেষদিকে নির্দেশনা আসার পর এখন মন্ত্রণালয়সহ সব পক্ষ নড়েচড়ে বসেছে। দুদকেও নাজমুলের মামলায় নতুন করে গতি পেয়েছে।

সম্পদের ফিরিস্তি : আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের চিত্র তুলে ধরে ১৮ ফেব্রুয়ারি এসএম নাজমুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক (অনু. ও তদন্ত) হাফিজুল হক। এজাহারে বলা হয়, এসএম নাজমুল হক ভোগ-দখল, গোপন, তার স্ত্রীর একাধিক ব্যাংক হিসাবে এবং একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছদ্মনামে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে যৌথ মূলধনি প্রতিষ্ঠান ৩টি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ওয়েস্টিন বাংলাদেশ লি., ওশেন মেরিন লি. ও আটলান্টিক মেরিটাইম একাডেমি। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে এসএন এন্টারপ্রাইজ, সওদা শাড়িজ, মৃদুলা শাড়িজ ও জামদানি শাড়িজ।

দুদকে দাখিলকৃত সম্পদবিবরণীতে নিজ নামে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ এবং ২ কোটি ২৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ ঘোষণা দেন। মামলার বাদী দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম তার সম্পদবিবরণী অনুসন্ধান শুরু করেন। এতে দেখা যায়, রমনার সিদ্ধেশ্বরীতে ডুমনি প্যাসিও অ্যাপার্টমেন্টে এ-১ ফ্ল্যাটের দাম দেখিয়েছেন ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা, খিলক্ষেত থানার ডুমনি মৌজায় ৫ কাঠার প্লটের দাম দেখানো হয়েছে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, পূর্বাচল মেরিন সিটিতে দুই দলিলে ১০ কাঠা জমি ৯ লাখ টাকা, তুরাগ থানার ভাটুলিয়া মৌজায় ১৬ দশমিক ৫ শতক জমি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায়, মিরপুরে রাকিন সিটিতে প্রতিটি ১৮৭২ বর্গফুটবিশিষ্ট ২টি ফ্ল্যাটের দাম ২ কোটি ৫২ লাখ ৭ হাজার ২৬১ টাকা। এছাড়া উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে আরেকটি দলিলে ৩৩ শতক জমি কিনেন ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকায়।সম্পদবিবরণী যাচাইকালে এসএম নাজমুল হক ও সন্তানদের নামে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, আলিকোতে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৫৫ টাকা, ভবিষ্যৎ তহবিলে ৩ লাখ ৬৩ হাজার টাকা, ঢাকা মেট্রো গ-৩৭-৪৪৩৮ প্রাইভেট কারের দাম ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ৫০ তোলা অলংকারের দাম ধরেছেন দেড় লাখ টাকা, তিনটি এফডিআর ৩০ লাখ টাকা, সোনালী ব্যাংক দিলকুশা শাখায় ১ কোটি ২১ লাখ ৪ হাজার ৮৭৯ টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মতিঝিল শাখায় ৩৬ লাখ ২৯ হাজার ১০৯ টাকা, ফারমার্স ব্যাংক মতিঝিল শাখায় ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৫৬ টাকা, নাজমুল হকের নামে শেয়ার আছে ২৩ হাজার ৪০২টি। মেয়ে মনতাহা নাজমুলের নামে ইসলামী ব্যাংক পান্থপথ শাখায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা, আরেক মেয়ে আরুশা নাজমুলের নামে একই ব্যাংক ও শাখায় ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৭১৮ টাকা। এমনকি লিমরা জেনারেল ট্রেডিং নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ী পার্টনারের মালিক আব্দুল হান্নানের দেয়া চেক ডিজওনারের দেড় কোটি টাকাও তার সম্পদে যোগ হয়েছে।

বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন, এসএম নাজমুল হক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৫৪ হাজার ৫৬২ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করেন। উক্ত সম্পদ গোপন করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬(২) ধারার অপরাধ সংগঠন করেছেন এসএম নাজমুল হক। সম্পদবিবরণী যাচাইকালে বাদী ৭ কোটি ২২ লাখ ৭৭ হাজার ২৪০ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া যায়। আয়কর নথি অনুযায়ী এ সময় তিনি ব্যয় করেছেন ৫৫ লাখ ৭ হাজার ৫৮৩ টাকা। এতে দেখা যায়, ব্যয় যোগ করে এই সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ কোটি ৭৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮২৩ টাকা। এর মধ্যে তার নামে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ১৮ হাজার ৭৭২ টাকা আয়ের বৈধতা পাওয়া যায়। এভাবে এসএম নাজমুল হকের দখলে থাকা ৭ কোটি ৭৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮২৩ টাকা থেকে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ১৮ হাজার ৭৭২ টাকা বাদ দিয়ে ৪ কোটি ২৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা আয়বহির্ভূত সম্পদ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে। দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। এছাড়া নাজমুল হকের ২০০৪-২০০৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-২০১৮ বছর সময়ে খাতওয়ারি বৈধ আয় ও সম্পদ অর্জনভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী ৯ কোটি ৯৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ করে তা গোপন করতে নিজের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবসহ স্ত্রীর একাধিক ব্যাংক হিসাব ছাড়াও উল্লিখিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছদ্মবেশে বিনিয়োগ করেছেন। এ কারণে নাজমুল হকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় অপরাধ করার অভিযোগ করেছে দুদক।অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসএম নাজমুল হক বলেন,মামলায় দুদক যেসব অভিযোগ করেছে,তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট।আমি উচ্চ আদালতে এ বিষয়ে তদন্ত স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করেছি। আমার সম্পদের বিষয়ে বৈধ কাগজপত্র আছে।মামলার সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে বাদী দুদকের উপপরিচালক (অনু. ও তদন্ত) হাফিজুল ইসলামের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এ বিষয়ে দুদকের তথ্য কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

Top