দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রস্তুতিতে বড় ধরনের ঘাটতি আছে বলে মনে হাইকোর্ট।
আলোকিত বার্তা:দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রস্তুতিতে বড় ধরনের ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন হাইকোর্ট।নতুন এই ভাইরাস ঠেকাতে সরকারের নেয়া উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে যথেষ্ট নয় বলেও আদালত মন্তব্য করেছেন।আদালত বলেছেন, করোনাভাইরাস ছড়ানোর প্রেক্ষাপটে মানুষের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। তবে মাস্ক নিয়ে পেঁয়াজের মতো ব্যবসা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতেহবে। মাস্ক, সেনিটাইজার নিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে সিন্ডিকেট, কালোবাজারি করতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা বলেছেন আদালত।সোমবার বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ মন্তব্যসহ এ আদেশ দেন। এর আগে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের নেয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের মহাপরিচালকের দেয়া প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এবিএম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।প্রতিবেদনটি দেখে আদালত বলেন, আমরা গণমাধ্যমের খবরে দেখলাম মাস্কের জন্য মানুষ দোকানে দোকানে লাইন দিচ্ছেন। একটা মাস্ক কিনতে যদি ৮০ থেকে ১০০ টাকা লাগে, সেটা দুঃখজনক। চীনের সঙ্গে তুলনা করে আদালত বলেন, সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়; কিন্তু যথেষ্ট নয়।
সরকার যেসব প্রিপারেশন নিয়েছে, সেখানে আমরা পিছিয়ে আছি। তবে প্যানিকের কিছু নেই। প্রিপারেশনে সিরিয়াস ঘাটতি আছে। আরও ব্যাপক আকার ধারণ করার আগেই প্রিভেন্টিভ মেজারগুলো নিতে হবে। এ নিয়ে অবহেলা, ঘাটতি থাকার কোনো সুযোগ নেই।আদালত বলেন, এক-দেড় মাস হয়ে গেছে এখনও স্ক্যানার কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বাজারে মাস্ক, সেনিটাইজার পাওয়া যাচ্ছে না। প্রস্তুতিতে ঘাটতি আছে। যদি ছড়িয়ে পরে, তাহলে মোকাবেলার প্রস্তুতি তো থাকতে হবে। কারণ, এর কোনো প্রতিষেধক নেই। আমরা গরিব দেশ। আমাদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই জরুরি। কিন্তু হোপ দেখছি না।এ পর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে এটা নিয়ে বাজারে কোনো ধরনের ব্যবসা হয় কি না পেঁয়াজের মতো, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট দিয়ে তদারকি করতে হবে।কেউ যাতে বেশি দাম না নিতে পারে, মজুদ না করতে পারে। ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে ছড়ালে আমরা কেউ নিরাপদ না। যে ব্যবসায়ী মাস্কের ব্যবসা করছে, সে ব্যবসায়ীও নিরাপদ না।
এ সময় আদালতে থাকা আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে সরকার রিয়ালাইজ করতে পেরেছে আশা করি। কিন্তু ১০ টাকার মাস্ক ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা চেয়ে তিনি বলেন, ইচ্ছে করলে সরকার সারা দেশে মাস্ক ফ্রি দিতে পারে।তখন বিচারক বলেন, যারা আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন তাদের দেয়া যেতে পারে। ১০-১৫ কোটি দেয়া সম্ভব না। এ সময় মওদুদ আহমদ চিকিৎসক, নার্সদের রোগ প্রতিরোধী বিশেষ পোশাকের মজুদ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। আদালত বলেন, যদি না থাকে আমরা দেখব।রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রতিদিনের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে এ বিচারক বলেন, আইইডিসিআর’র একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি প্রেস ব্রিফিং করেন। ওনার বক্তব্য আরও পজিটিভ হওয়া বাঞ্ছনীয়।এটা যেন কোনোভাবে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে। ওনারা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো জানানো দরকার। মানুষ কীভাবে সচেতন হবে এবং কী করা দরকার, সে বিষয়গুলো মানুষকে জানানো দরকার।এ সময় নভেল কেরোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে আবেদন করেন সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী। তিনি এ বিষয়ে নির্দেশনা চাইলে আদালত আদেশ না দিয়ে ৫ এপ্রিল শুনানির জন্য রাখে।৫ মার্চ নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানতে চেয়েছিল। সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনার পর হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনটি বিষয় জানতে চেয়ে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিল।নির্দেশনা তিনটি ছিল- প্রথমত, স্থলবন্দর, নৌবন্দর, বিমানবন্দর, বিশেষ করে বিমানবন্দর দিয়ে যখন বিদেশিরা বাংলাদেশে ঢুকছেন, তখন তাদের কী ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। যারা পরীক্ষা করছেন তারা প্রশিক্ষিত কি না এবং যে যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে সেগুলোর সক্ষমতা রয়েছে কি না।
দ্বিতীয়ত, সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনাভাইরাসের জন্য পৃথক ক্যাবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা। তৃতীয় নির্দেশনাটি ছিল, করোনাভাইরাস পরীক্ষা বা শনাক্তের কিট, সরঞ্জাম দেশে পর্যাপ্ত রয়েছে কি না, যদি না থাকে তবে জরুরি ভিত্তিতে আমদানি করার কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ওই নির্দেশের ধারাবাহিকতায় সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. আমিনুল ইসলাম হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এই প্রতিবেদনে নতুন করোনাভাইরাসের পাঁচটি লক্ষণের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
নতুন করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলো : ১. ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন সময় লাগে। ২. প্রথম লক্ষণ জ্বর। ৩. এরপর শুকনো কাশি। ৪. এক সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ৫. পরবর্তী সময়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন- কিডনি অকার্যকর হতে পারে এবং মৃত্যুও হতে পারে।
রোগের চিকিৎসা : ১. যেহেতু এই ভাইরাসটি নতুন, তাই এর কোনো টিকা/ভ্যাকসিন এখনও নেই। ২. চিকিৎসা দিতে হয় লক্ষণভিত্তিক। ৩. অসুস্থ হলে ঘরে থাকুন, ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং মাস্ক ব্যবহার করুন।
এই রোগ যেভাবে প্রতিরোধ করতে হবে : ১. ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুবেন (অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে)। ২. অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না। ৩. এর মধ্যেই আক্রান্ত এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
৪. হাঁচি/কাশির সময় বাহু/টিসু/কাপড় দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখুন। ৫. অসুস্থ পশু/পাখির সংস্পর্শ পরিহার করুন। ৬. মাছ-মাংস ভালোভাবে রান্না করে খাবেন। ৭. জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত চীন ও অন্যান্য আক্রান্ত দেশে ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকুন।
সন্দেহভাজন রোগীদের ক্ষেত্রে করণীয় : ১. অসুস্থ রোগীদের ঘরে থাকতে বলুন। ২. মারাত্মক অসুস্থ রোগীকে কাছের হাসপাতালে যেতে বলুন। ৩. রোগীকে নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে বলুন। ৪. আইইডিসিআর’র হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করুন।
চীন থেকে ছড়ানো নভেল করোনাভাইরাস এ পর্যন্ত একশটির বেশি দেশে বিস্তৃত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে এই রোগে (কোভিড-১৯) আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ আট হাজারের বেশি, আর মৃতের সংখ্যা ৩৮০০ জনে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশেও তিনজনের শরীরে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।