জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে যে শঙ্কা রয়ে গেছে
মোহাম্মাদ মহাব্বাতুল্লাহ মাহাদ:জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোটের ঘোষণা এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সামনে এসেছে। কোন কোন রাজনৈতিক দল স্পষ্টতই বলছে, জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশে ‘অস্পষ্টতা’ রয়ে গেছে। কোন কোন রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও মতামত দিচ্ছেন।রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন’ নিয়ে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে।বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নেতারা অভিযোগ করেছেন, একটি দলের সঙ্গে ‘আপস’ করে সংস্কার কমিশনের সুপারিশে অনেক পরিবর্তন এনে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ এবং জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছে দলটি। সেইসাথে সমমনা ৮টি দল আন্দোলনে থাকার বিষয়ে অনঢ় থাকার ঘোষণা দিয়েছে।তবে জুলাই সনদ ইস্যুতে সমালোচনা করলেও জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোটের ঘোষণা দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে দলটি। বলা হচ্ছে, জুলাই সনদ, নির্বাচন ও সংস্কার ঘিরে দেশের রাজনীতিতে নতুন সংকট ঘনিভূত হচ্ছে।
গণভোট ইস্যুতে যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে তার মধ্য দিয়ে সংস্কারের সব বিষয়কে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে দাবি করছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনে আছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ৮টি রাজনৈতিক দল। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট দেওয়াতে গণভোটের গুরুত্ব কমেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। নতুন কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ক্ষমতায় এসে সেগুলোকে বাতিল করে দিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন,জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।কারণ এই আদেশটি এমনভাবে করা হয়েছে,যাতে ক্ষমতাবানরা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করতে পারেন।
আখতার হোসেন বলেন, আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম সরকার অস্পষ্টতা দূর করে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি উল্লেখ করবে। আগে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের আওতায় চলে আসার বিধান ছিল। বাস্তবায়ন আদেশে ১৮০ দিনের কথা বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা ব্যর্থ হলে তার ফলাফল কী হবে, এগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে কিনা, সে বিষয়ে অস্পষ্টতা এখনো রয়ে গেছে।
এনসিপির এই শীর্ষ নেতার আশংকা– ভবিষ্যতে ক্ষমতা পেলে তারা বর্ণিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী তাদের নিজেদের মতো করে নোট অব ডিসেন্টকে প্রধান করে তোলার সুযোগ থাকবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্ট থাকবে কিনা, সে বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এনসিপির এই নেতা বলেন, গণভোটে ‘অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান’ বলতে কোনগুলোকে বোঝানো হয়েছে, তা বাক্যের মধ্যে স্পষ্ট নয়। প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে পারবেন কিনাÑএ বিষয়ে গণভোটের মতামত জানার পরও কেন রাজনৈতিক দলকে নিজেদের মতো সংস্কার করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের বিষয়ে ঐকমত্য হলেও, সেটি অন্তর্ভুক্ত থাকবে কিনা তাও পরিষ্কার করা হয়নি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলছেন, একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হলে গণভোটের গুরুত্ব কমবে। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে জামায়াতসহ আটটি দল যে কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন তা চালিয়ে যাওয়ার কথাই বলছেন দলগুলোর নেতারা। ডা. তাহের সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট অনুষ্ঠিত হতে হবে, এখনো এই সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর জুলাই জাতীয় সনদ ইস্যুতে সমালোচনা করলেও রাতে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর, জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানানো হয়। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ প্রসঙ্গে দলটির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, এর “আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সাধারণ প্রজ্ঞাপন, নোটিফিকেশন হলে এই প্রশ্ন তুলতাম না”। একইসাথে সংবিধান সংস্কার পরিষদ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে দলটি। তাদের দাবি, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কোনো এজেন্ডা ঐকমত্য কমিশনে ছিল না। ফলে এ নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণের মধ্য দিয়ে নিজেই নিজের সই করা জুলাই সনদ লঙ্ঘন করেছেন বলে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তবে দুপুরে সমালোচনা করলেও রাতে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটিরি বৈঠকের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা পুনর্ব্যাক্ত করায় এবং সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়”। গত ১৭ই অক্টোবর ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদের ওপর গণভোট অনুষ্ঠানের আহ্বান জানায় দলটি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন,একই সাথে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন হলে অধিকাংশ গণভোটের ব্যালট পেপার ফাঁকা থাকবে। সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, ‘গণভোটের যে বিষয়ের উপর জনগণ “হ্যাঁ” বা “না” ভোট দেবেন, তাদের তো আগে বিষয়গুলো বুঝতে হবে। তাই একই দিনে হলে জাতীয় নির্বাচনমুখী থাকবে মানুষ, ফলে গণভোটের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেকেই ভোট না দিয়ে ব্যালট ফাঁকা রাখবেন।
জুলাই সনদ নিয়ে তৈরি করা গেজেটে বলা হয়েছে, নির্বাচিত সংসদকে প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ এবং গণভোটের ফলাফল অনুসারে সাংবিধানিক সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। বিধানটিকে ‘অ্যাবসার্ড’ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ‘এসব আইনের ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দেওয়া কিংবা পরবর্তীতে আলোচনার বিষয়টি সাধারণত থাকে না। তাই এসব দিন ধার্য করে দিয়েও লাভ নেই, যদি সংসদ সেটাকে গুরুত্ব না দেয়। তিনি আরও বলেন, ‘যদি নির্বাচিত সরকার প্রথম অধিবেশনে সনদ কিংবা গণভোটের বিষয়ে “না” ভোট দেয়, তাহলে তো আর ১৮০ দিন বেঁধে দিয়ে লাভ নেই। সংসদেই যদি বিষয়টি পাশ না হয়, তাহলে পরবর্তীতে সেটা বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা তো আর থাকে না। তিনি আরও বলেন, সংসদ সদস্যরা যদি পূর্বের কোনো অধ্যাদেশ দ্বারা ‘আবদ্ধ’ থাকেন, তাহলে নতুন কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ক্ষমতায় এসে সেগুলোকে বাতিল করে দিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।
বৃহস্পতিবারের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত সনদকে মূল দলিল হিসেবে ধরে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় জুলাই জাতীয় সনদ ও সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ অনুমোদন করে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই আদেশে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে সংবিধান সংস্কারবিষয়ক গণভোট অন্যতম।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে জাতির ক্রান্তিলগ্নে এবং প্রশাসনিক এবং সাংবিধানিক প্রয়োজনে তিনটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, ১৯৮৫ সালে এরশাদের আমলে এবং ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে। এর মধ্যে দুটি প্রশাসনিক এবং একটি সাংবিধানিক ভোট হয়েছে। তবে প্রতিটি গণভোট রাজনৈতিক মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন ইতিহাস। এবার গণভোট হলে তা হবে চতুর্থ বারের মতো।