কমছে মানুষের হাতে নগদ রাখার প্রবণতা ,ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরছে
মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন:ব্যাংক খাতে গ্রাহকদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এর ফলে কমেছে মানুষের হাতে নগদ অর্থ রাখার প্রবণতা। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবাহ ক্রমেই বাড়ছে। ব্যাংক খাতে গত এক বছরেরও বেশি সময় স্থবিরতা থাকার পর এই প্রবৃদ্ধিকে অর্থনীতিবিদরা ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, এটি জনগণের ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধারের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা গত ১৮ মাসের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যায় পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে দেড় দশকে আওয়ামী লুটপাটের অবসান ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকার ভেঙে পড়া ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়। ব্যাংক ডাকাত এস আলমের দখলমুক্ত করা হয় দেশের আটটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। একই সাথে সালমান এফ রহমানের হাত থেকে আইএফআইসি, নাসার নজরুল ইসলাম মজুমদারের হাত থেকে এক্সিম ব্যাংক, শিকদার গ্রুপের হাত থেকে ন্যাশনাল ব্যাংক উদ্ধার করা হয়। এসব ব্যাংক থেকে পতিত আওয়ামী লীগের আমলে পানির মতো টাকা বের করে নেয় মাফিয়া চক্রটি। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। এ কারণে ব্যাংকিং খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থা তলানিতে নেমে যায়। মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে নিজেদের কাছে রাখতে শুরু করে। এতেই ব্যাংকবহির্ভূত মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতেই দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা ফেরানোর কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়। ব্যাংক লুটেরাদের আইনের আওতায় আনা হয়। তাদের দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নেয়। দেশীয় সম্পদগুলো ইতোমধ্যে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে গ্রাহকের মধ্যে অনেকটা আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। বাড়ছে ব্যাংকের আমানত প্রবাহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই অঙ্ক ছিল ১৭ লাখ ৪১ হাজার কোটি কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে প্রায় এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে ব্যাংক খাতের মোট আমানতে। এর আগের মাস আগস্টে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ০২ শতাংশ, যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগস্টে এই ইতিবাচক ধারা শুরুর আগে টানা ১৩ মাস ধরে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশের নিচে। ২০২৪ সালের জুন মাসে প্রবৃদ্ধি হার ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতের ধারাবাহিক ইতিবাচক পরিবর্তনকে একপ্রকার টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ ও তিনটি মূল কারণ : অর্থনীতিবিদদের মতে, সেপ্টেম্বরের এই প্রবৃদ্ধি ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার বার্তা দিয়েছে। তারা আমানত বৃদ্ধির তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেনÑ প্রথমত, শক্তিশালী ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের ঝোঁক বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি সুদের হার এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মুনাফা হ্রাস।
বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক আমানতের ওপর ৮ দশমিক ৫ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করছে। এই হার সেপ্টেম্বরে রেকর্ড করা ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে বেশি, ফলে ব্যাংকে আমানত রাখলে প্রকৃত অর্থে গ্রাহকরা কিছুটা লাভবান হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বরে গড়ে আমানতের সুদের হার ২৫ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বেড়েছে, যা মানুষকে ব্যাংককে আবারো নিরাপদ বিনিয়োগের জায়গা হিসেবে বিবেচনা করতে উৎসাহিত করেছে। অন্য দিকে একই সময়ে ট্রেজারি বিল ও সরকারি বন্ডের মুনাফা হার হ্রাস পাওয়ায় অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে অর্থ সরিয়ে ব্যাংকে স্থানান্তর করছে।
নগদ অর্থের পরিমাণ হ্রাস : আস্থার আরেক প্রতিফলন বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে জনগণের হাতে থাকা নগদের পরিমাণ এক বছরে আট হাজার ৮২৯ কোটি টাকা কমেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে নগদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল দুই লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। এই তথ্য প্রমাণ করে, জনগণ আবারো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফিরে আসছে। পূর্ববর্তী মাসগুলোতে নগদ অর্থ ধরে রাখার প্রবণতা থাকলেও এখন তা কমছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ও তুলনামূলক বেশি সুদের হার এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, আমানত প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং খাতে তারল্যসঙ্কট হ্রাস পাবে এবং ঋণপ্রবাহ স্বাভাবিক হবে। পাশাপাশি, বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে অর্থের সরবরাহ বাড়বে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা আরো মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে থাকলে এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে আগামী বছর আরো দ্বিগুণ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন ও পরিচালনা পর্ষদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।