দেশে আশঙ্কাজনক হারে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়েনি - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশে আশঙ্কাজনক হারে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়েনি


ডা.মুন্সী মুবিনুল হক :দেশে আশঙ্কাজনক হারে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়েনি। ক্যানসার চিকিৎসায় দক্ষ জনবল এবং যন্ত্রপাতির রয়েছে চরম সংকট।ফলে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসা।বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যানসার চিকিৎসার জন্য সব ধরনের সেবা থাকতে হবে এক ছাদের নিচে, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা ও থেরাপি, চিকিৎসা পরবর্তী যত্ন ও পুনর্বাসন সেবা থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় দেশে সেইরকম কোনো প্রতিষ্ঠান এখনও গড়ে ওঠেনি।প্রায় চার দশক আগে দেশে ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু হলেও দীর্ঘ সময়েও তা পূর্ণতা পায়নি। দেশের একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতালটিও ধুঁকছে জনবল ও যন্ত্রপাতির সংকটে।বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তবে এসব স্থানে চিকিৎসাসেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

প্রতি লাখে ক্যানসার আক্রান্ত ১০৬ জন
সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) একটি গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রতি লাখে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০৬ জন। এ ছাড়াও প্রতি বছর নতুন করে ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছে ৫৩ জন। মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশই ক্যানসার রোগী।

বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যানসার রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে স্তন, মুখ, পাকস্থলি, শ্বাসনালি এবং জরায়ু মুখের ক্যানসার রোগীর সংখ্যাই বেশি। আক্রান্তদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ রোগীর বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছর। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ২ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু এবং ৫ দশমিক ১ শতাংশ রোগীর বয়স ৭৫ বছরের বেশি।

গবেষণায় প্রাপ্ত ফলে দেখা গেছে, দেশে ৫টি প্রধান ক্যানসার হলো—স্তন, মুখ, পাকস্থলি, শ্বাসনালি এবং জরায়ু মুখের ক্যানসার। পুরুষদের ৫টি প্রধান ক্যানসার হলো—শ্বাসনালি, পাকস্থলি, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালির ক্যানসার। নারীদের ৫টি প্রধান ক্যানসার হলো— স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড এবং ওভারি।

গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে এক লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জনের মৃত্যু হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এই তথ্য দেশের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করে না। কারণ, বাংলাদেশে ক্যানসার সংক্রান্ত সঠিক তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। দেশের একাধিক ক্যানসার চিকিৎসকেরাও এই তথ্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন।

অপ্রতুল চিকিৎসাকেন্দ্র
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি করে ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা দরকার। যেখানে কেমোথেরাপি, সার্জারি এবং রেডিওথেরাপির ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি আনুমানিক ১৭ কোটিও হয়, তাহলে সেই অনুযায়ী ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে অন্তত ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা দরকার। কিন্তু বাস্তবে সরকারি বেসরকারি মিলে আছে ৩০ থেকে ৩৫টি। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় দেশে প্রায় পাঁচগুণেরও কম চিকিৎসাকেন্দ্র আছে। এর মধ্যে আবার বেশিরভাগই রাজধানী ঢাকায়।

দেশে ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র
সরকারি পর্যায়ে দেশের একমাত্র ক্যানসার চিকিৎসার বিশেষায়িত কেন্দ্র হচ্ছে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, সিলেটে ওসমানী মেডিকেল কলেজ এবং ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ও বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসার বিভাগ রয়েছে। বিএমইউর ক্লিনিক্যাল অনকোলজি, গাইনোলজিক্যাল অনকোলজি, পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি ও রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগ রয়েছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালেও অনকোলজি বিভাগ রয়েছে।

বেসরকারি পর্যায়ে ক্যানসার চিকিৎসায় বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র হচ্ছে আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল। পাশাপাশি মিরপুরের ডেলটা হাসপাতাল, সাভারের এনাম মেডিকেল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল ও এভারকেয়ার হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসা হয়।ঢাকার বাইরে আছে বগুড়ার ঠ্যাঙ্গামারা মেডিকেল কলেজ, সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল, সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল, সিলেটের ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল, চট্টগ্রাম এভারকেয়ার হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল। এছাড়াও আরও কিছু বেসরকারি হাসপাতালে স্বল্প পরিসরে ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট
দেশে কতজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। কেউ বলছেন, দেশে ১৩০ জন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন দেশে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সার্জন এবং রেডিও থেরাপিস্ট ও যারা বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার চিকিৎসার সাথে জড়িত— এই সংখ্যা ৩০০ এর কিছু কম বেশি হতে পারে। তবে দেশে ক্যানসার রোগীর অনুপাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চরম ঘাটতি রয়েছে, এ বিষয়ে সকলেই একমত পোষণ করেন।

রেডিওথেরাপি মেশিনের সংকট
ক্যানসারের অন্যতম একটি চিকিৎসা হচ্ছে রেডিওথেরাপি। রেডিওথেরাপি হলো এক ধরনের চিকিৎসা, যা উচ্চ শক্তির বিকিরণ ব্যবহার করে ক্যানসারের কোষ ধ্বংস করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে রেডিওথেরাপি মেশিনের সংখ্যা খুবই সীমিত। জনসংখ্যা অনুপাতে ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রে একটি করে রেডিওথেরাপি মেশিন থাকলেও দেশে অন্তত ১৭০টি মেশিন থাকার কথা। তবে বাস্তবে রয়েছে মাত্র ৩৭টি মেশিন রয়েছে, যার অনেকগুলোই আবার অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। ফলে রোগীদের দীর্ঘ অপেক্ষায় সময় পার করতে হয়। বেসরকারি পর্যায়ে রেডিওথেরাপি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

ক্যানসারের ওষুধে সাফল্য
বর্তমান সময়ে দেশেই তৈরি হচ্ছে ক্যানসারের চিকিৎসার সর্বাধুনিক ওষুধ। ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় ৯৫ শতাংশ ওষুধ তৈরি করে দেশের ফার্মা কোম্পানিগুলো। উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশে তৈরি ক্যানসারের ওষুধের দামও অনেক কম। তবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় অনুপাতে ক্যানসারের ওষুধ এখনো অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
অতি সম্প্রতি ক্যানসার বিষয়ক এক সেমিনারে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান বলেন, ১৭ কোটি মানুষের দেশে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য কার্যত একটিমাত্র হাসপাতাল এবং সেটিরও পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই। ক্যানসার চিকিৎসা, স্ক্রিনিং ও পরবর্তী যত্ন, সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ভয়াবহ ঘাটতির মধ্যে আছে। রোগীরা ভর্তি হতে না পেরে লাইনে দাঁড়ায়, কেউ কেউ রাস্তায় শুয়ে থাকে।

মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, আমাদের দেশে এখন সক্ষমতা গড়ে উঠছে, অধিকাংশ ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যদিও আমাদের জনবল সংকট, যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে এবং রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তবুও চিকিৎসা ও সেবার মান উন্নয়নে কাজ চলছে।

তিনি আরও জানান, শুধু ভবন বা অবকাঠামো করলেই হবে না, যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল ছাড়া উন্নত চিকিৎসা সম্ভব নয়। আমাদের হাসপাতালে বর্তমানে মাত্র ৩০০ জনবল দিয়ে প্রায় ৫০০ রোগীর চিকিৎসা চলছে।

ক্যানসার চিকিৎসা সহজলভ্য করতে কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে জানতে চাইলে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যানসার রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক প্রধান এবং গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যানসার হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, ক্যানসারের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্যানসার চিকিৎসার পরিধি বাড়ানো উচিৎ। মেডিকেল কলেজগুলোতে ক্যানসারের বিশেষায়িত ইউনিট গড়ে তোলা উচিত।

তিনি আরও বলেন, বেসরকারি ক্যানসার চিকিৎসা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চ মাত্রায় টাকা নেওয়া হচ্ছে কি না, সরকারের মনিটরিং থাকা দরকার। ক্যানসার চিকিৎসায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আরও বেশি হওয়া উচিত।

দেশে ক্যানসার চিকিৎসার প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ক্যানসার অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. মাসুমুল হক বলেন, দেশে রেডিও থেরাপি মেশিন প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। ৩৫টা মেশিনের মধ্যে ২৫টা কার্যকর আছে। বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালে মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে যতগুলো মেশিন আছে, তার তুলনায় রোগীর চাপ প্রচুর। জনসংখ্যার অনুপাতে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং দক্ষ জনশক্তিরও যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে ক্যানসার বিষয়ে যতটুকু কাজ হচ্ছে, তা চিকিৎসা নির্ভর। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য উৎসগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে না। ক্যানসার অ্যাওয়ারনেস, স্ক্রিনিং, প্রিভেনশন, ট্রিটমেন্ট সবগুলোকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সরকারি বেসরকারি সমস্ত সংস্থার উদ্যোগে একটা ন্যাশনাল ক্যানসার কন্ট্রোল পলিসি তৈরি করতে হবে, তা না হলে ক্যানসার ঠেকানো সম্ভব নয়।

Top