দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক দৈন্যের শেষ নেই,সঞ্চয় ভেঙে দায় মেটাচ্ছে মধ্য-নিম্নবিত্তরা
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক দৈন্যের শেষ নেই।খাবারের পেছনেই ব্যয় তিনগুণ ,সঞ্চয় ভেঙে দায় মেটাচ্ছে মধ্য-নিম্নবিত্তরা। বেসামাল বাজার পরিস্থিতি সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ফেলে দিয়েছে চরম সংকটে। এর মধ্যে দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে পড়েছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও এসব কষ্টের কথা শেয়ার করা যায় না। অনেকে ঘরের বাজারের বাজেট কাটছাঁট করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। অনেক পরিবারে মেহমানদারিও বন্ধ হয়ে গেছে। রাজধানীর কমিউনিটি সেন্টারগুলোয় আগের মতো আর বিয়ের অনুষ্ঠান হয় না। এ সংকট যে গত এক বছরের, এমনটি নয়। কয়েক বছর ধরেই এক নাজুক পরিস্থিতির ওপর দিয়ে যাচ্ছে এসব পরিবারের জীবন।তাদের আয় বাড়েনি, বেড়েছে ব্যয়। ফলে সংসারের খরচ মেটাতে গিয়ে সঞ্চয় ভেঙে দায় মেটাতে হচ্ছে। অনেকে আবার করছেন ধারদেনা। এসব পরিবারের গল্প এমন জায়গায় ঠেকেছে-কাউকে অভাব-অভিযোগের কথাও বলতে পারছেন না।
এদিকে শুধু নিত্যপণ্যের দাম নয়, বেড়েছে পরিবহণ খরচ, চিকিৎসা ব্যয়, এমনকি শিশুর শিক্ষা-সবখানেই খরচ বাড়ছে হুহু করে। এমন পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি মাসে ৪০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করেও ৪-৫ জনের সংসারের ব্যয় বহন করতে পারছেন না। সবমিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া যারা দিন এনে দিন খান, তাদের কষ্ট বর্ণনা করার মতো নয়। তারা যেন আরও খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। আবার রোজগারের তুলনায় ব্যয় কমাতে অনেকেই পরিবার-পরিজন গ্রামে পাঠিয়ে নিজে শহরে থাকছেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার-পিপিআরসির এক গবেষণায় উঠে এসেছে, তিন বছরের ব্যবধানে শহরের পরিবারের মাসিক আয় কমলেও বেড়েছে খরচ। শহরের একটি পরিবারের গড়ে মাসিক আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা। খরচ হয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। ২০২২ সালে এ আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে ৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে গ্রামের পরিবারের গড় আয় কিছুটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ২০৫ টাকা। তাদের মাসিক খরচ ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। ২০২২ সালে গ্রামের একটি পরিবারের গড় আয় ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে গ্রামের মানুষের বেড়েছে ৩ হাজার ৪২ টাকা। তবে সার্বিক ও জাতীয়ভাবে একটি পরিবারের মাসে গড় আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। খরচ হয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা। সঞ্চয় নেই বললেই চলে।
পিপিআরসির জরিপে আরও দেখা যায়, একটি পরিবারের মাসিক মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় খাবার কেনায়। সেক্ষেত্রে পরিবারে খাবার কিনতে মাসে গড়ে ১০ হাজার ৬১৪ টাকা খরচ করে।
এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিবারকে শুধু খাবারের পেছনে মাসে ব্যয় করতে হচ্ছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। ২০১০ সালে মাসে খরচ হতো ১১ হাজার ২০০ টাকা।
রাজধানীর খুচরা বাজারে বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি চাল ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। কেজিপ্রতি আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৫-৮ টাকা। প্রতি লিটার সয়াবিন তেল কিনতে ক্রেতার বেশি ব্যয় হচ্ছে ১৮ থেকে ২২ টাকা। বছরের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ২০-২৫ টাকা। একাধিক মাছের দাম কেজিপ্রতি ৩০-৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগির দাম ১০-২০ টাকা বাড়লেও দেশি মুরগির দাম বেড়েছে ৭০ টাকা। পাশাপাশি বছরের ব্যবধানে শিশুখাদ্যের দাম ৭০-১০০ টাকা বেড়েছে। এছাড়া সব ধরনের সেবার দামও বেড়েছে লাগামহীনভাবে। বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ৫ শতাংশ করে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে গ্যাসের দাম। উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে জ্বালানি তেল। এতে শিল্পপণ্যসহ সব ধরনের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও বেড়েছে। চলমান এই পরিস্থিতিতে স্বল্প-আয়ের মানুষের নিত্যদিনের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কমাতে হচ্ছে ভ্রমণ, শিক্ষা, বিনোদনসহ অন্যান্য খাতের খরচ। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার খাবারের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে।
রাজধানীর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. মুস্তাকিম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। মাসে পান ৪৫ হাজার টাকা বেতন। মা, স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। পরিবারের খাবার জোগাড় করতে মাসে ৫০ কেজির এক বস্তা চাল ৩ হাজার ২০০; পাঁচ লিটার তেল ৯২৫; বাসা ভাড়া ১৪ হাজার; বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল ৩ হাজার; সবজি, মাছ, ব্রয়লার মুরগিসহ তরকারি ও রান্নার উপকরণ কিনতে ৭ হাজার; সাবান-ডিটারজেন্ট ও শ্যাম্পু ৭০০; মুদি বাজার আরও ২ হাজার এবং মোবাইল টকটাইমে খরচ ও ইন্টারনেট বিল ১২০০ টাকা ব্যয় হয়। পাশাপাশি সন্তানের শিক্ষাব্যয় ৭ হাজার, পরিবারের যাতায়াত ব্যয় ৫ হাজার এবং মাসে গড়ে চিকিৎসা ব্যয় ২ হাজার টাকা ধরে ৪৬ হাজার ২৫ টাকা ব্যয় হয় তার। প্রতি মাসে তার ঘাটতি থাকে কম হলেও ১ হাজার ২৫ টাকা। তিনি বলেন, বেতন দিয়ে মাস চালাতে পরছি না, ফলে একটু ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। তিনি জানান, আগে মাঝেমধ্যে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে বের হলেও এখন তা পারছি না। একই দশা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হামিদুর রহমানের। দুই ছেলে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে থাকেন মালিবাগে। বেতন পান ৭১ হাজার ৫০০ টাকা। ২ বছর আগে এ টাকায় বেশ ভালোই চলতেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না।
কাওরান বাজারে কথা হয় দিনমজুর মো. আব্দুল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, যেদিন কাজ পাই, সেদিন ৬০০-৮০০ টাকা মজুরি পাই; যা ছয় বছর ধরে একই। মজুরি বাড়েনি। সব মিলে মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা আয় হয়। আমি ঢাকায় একটি মেসে থাকি। সেখানে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। খাবার ও অন্যান্য খরচ ৩ হাজার টাকা রেখে বাকি টাকা গ্রামে পাঠাই। সব মিলে সামনে কীভাবে সংসার চালাব, বুঝতে পারছি না।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বাড়ছে। সেই ব্যয়বৃদ্ধিও সমস্যা হতো না যদি একই হারে আয় বাড়ত। এক্ষেত্রে মানুষ টিকে থাকার জন্য সঞ্চয় ভেঙে অথবা ঋণ করতে হচ্ছে। কিন্তু যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন, তাদের তো কোনো সঞ্চয় নেই। কিংবা কেউ ধারও দেন না। এ অবস্থায় তারা আরও খারাপ অবস্থায় আছেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, প্রতিবছর পণ্য ও সেবার দাম বাড়ছে। কিন্তু সেভাবে ক্রেতার আয় বাড়ছে না। আয় না বাড়ায় সাধারণ মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক ক্রেতা অপরিহার্য পণ্য ছাড়া অন্য কিছু কেনা বাদ দিয়েছেন। তাই সংশ্লিষ্টদের উচিত পণ্য ও সেবার দাম কীভাবে কমানো যায়, তা চেষ্টা করা।