ফের আতঙ্ক আগুন সন্ত্রাস ,১৩ নভেম্বর ঘিরে গুজব উত্তেজনা
মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া:রাজনীতির মাঠে আবারও ফিরে এসেছে আগুন সন্ত্রাসের ভয়াবহতা।রাজধানী ঢাকায় আরও পাঁচটি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল(আইসিটি)তদন্ত সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চত্বরে নিক্ষেপ করা হয়েছে ককটেল।ময়মনসিংহে বাসে আগুনে মৃত্যু হয়েছে ঘুমন্ত চালকের।আহত হন আরও দুজন।আগের দিনও ককটেল নিক্ষেপ করা হয় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে,তিনটি বাসে করা হয় অগ্নিসংযোগ। এসব ঘটনায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। মানুষ এখন গণপরিবহণে উঠতে ভয় পাচ্ছেন।এর সঙ্গে একের পর এক খুন উদ্বেগ বাড়িয়েছে নাগরিকদের মনে। সোমবার রাজধানীতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার পর মঙ্গলবার গুলশানে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মোহাম্মদপুরে উদ্ধার করা হয়েছে ছাত্রদল নেতার লাশ। এর ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা অপপ্রচারে মানুষ যেন ফিরে গেছে ২০১৪-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক ভয়াবহ দিনগুলোতে। একটি মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, ওই সময় মাত্র তিন মাসেই পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়ে মারা যান ১৫৩ জন সাধারণ মানুষ। আহত হন দুই হাজারেরও বেশি, যাদের অনেকেরই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, কারও হাত, কারও পা কেটে ফেলতে হয়েছে।যদিও সরকার বলছে, আগুন সন্ত্রাসের রাজনীতি আর কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। কোনো ধরনের নাশকতা ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার মেয়াদ আরও সাড়ে তিন মাস বাড়ানো হয়েছে, যা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। তবু জনমনে শঙ্কা কাটছে না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী জানিয়েছেন, ১৩ নভেম্বর ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে তা ভিত্তিহীন। পরিস্থিতি পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। ঢাকাবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। ককটেল বিস্ফোরণ বা ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্কের কিছু নেই। তিনি আরও জানান, ১৩ নভেম্বরের জন্য ডিএমপি ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও প্রবেশমুখগুলোতে পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল মোতায়েন থাকবে। ডিএমপি কমিশনার জানান, পুলিশ সব সময় সংযম দেখিয়েছে। আমরা কোনো মারণাস্ত্র বা লাঠি ব্যবহার ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। গণমানুষের দাবি শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হওয়া উচিত।এদিকে চট্টগ্রামে একের পর এক গুলি ও হত্যার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন কমিশনার হাসিব আজিজ আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র ব্রাশফায়ার করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে ওয়্যারলেস সেটে সিএমপির সব সদস্যের উদ্দেশে দেওয়া মৌখিক নির্দেশনায় তিনি টহল ও থানা পুলিশকে একযোগে এ নির্দেশনা দেন। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কয়েক দফায় তিনি একই নির্দেশনা দেন বলে নিশ্চিত করেছে সিএমপির একাধিক সূত্র।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ১৩ নভেম্বর ঘিরে আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও বড় কোনো সহিংসতা হয়নি। পুলিশ-র্যাবসহ সব বাহিনী প্রস্তুত আছে। আগুন সন্ত্রাসে জড়িত কেউ রেহাই পাবে না। তিনি আরও বলেন, রাস্তার পাশে জ্বালানি তেল বিক্রি কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকবে, যাতে এসব তেল কিনে দুর্বৃত্তদের আগুন লাগানোর সুযোগ না থাকে।
এদিকে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগই আগুন সন্ত্রাসের উৎপাদক। তারা নিজেরাই সংঘাত সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যাতে সন্ত্রাসের রাজনীতি স্থায়ী না হয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ছোট ছোট হামলার মাধ্যমে জনগণের মনে ভয় তৈরি করাই দুর্বৃত্তদের লক্ষ্য। যাতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়ে। তারা বলছেন, আগুন সন্ত্রাসের এই ধারাবাহিকতা দেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, অস্থিরতা রুখতে হলে নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এজন্য প্রশাসনকে চোখ-কান খোলা রেখে আরও কঠোর হতে হবে।
কাল বৃহস্পতিবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায়ের দিন ঘোষণা করার কথা রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের। দিনটিকে ঘিরে এ উত্তেজনা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অনলাইন ও অফলাইনে ‘লকডাউন’ কর্মসূচির আহ্বান জানিয়ে উসকানিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় গত এক সপ্তাহে ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ ও চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে সেই প্রচারণাকে জোরদার করা হয়েছে। সর্বশেষ সোমবার গভীর রাত থেকে মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত ঢাকায় চারটি বাস ও একটি প্রাইভেটকারে আগুন এবং একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়-সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ ও কাজলা টোল প্লাজার কাছে তিনটি বাস, উত্তরা জনপথ মোড়ে একটি বাস এবং বসুন্ধরায় একটি প্রাইভেটকারে আগুন ধরানো হয়। বাসগুলোতে কোনো যাত্রী ছিলেন না। এছাড়া হাতিরঝিলের ইস্পাহানি স্কুলের সামনে ককটেল নিক্ষেপে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান জানান, ধানমন্ডি ১১/এ এলাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা কার্যালয়ের সামনে রাত ৮টার দিকে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। পরে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় মিছিলের চেষ্টা করলে দুজনকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর আগে সোমবার গভীর রাতে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার একটি পেট্রোলপাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যান ওই বাসের চালক জুলহাস উদ্দিন (২৮), আহত হন আরও দুজন।
যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে দুই বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মঙ্গলবার রজনীগন্ধ্যা বাসের মালিক কামাল উদ্দিন ও রাইদা পরিবহণের মালিক আরিফুল ইসলাম শান্ত বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেছেন। এতে একজনকে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত ২৬৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি কামরুজ্জামান তালুকদার যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় রাব্বি শেখ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, নিষিদ্ধ একটি রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগ) চলতি মাসের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ১৮টি ককটেল বিস্ফোরণ ও ১০টি যানবাহনে আগুন দিয়েছে। এসব ঘটনায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ১৭টি মামলা হয়েছে। এদিকে রাতে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, ঝটিকা মিছিল ও নাশকতার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ২২ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। সূত্রমতে, অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও আশপাশে ১৪টি ঝটিকা মিছিল করে ওই দল ও তাদের অঙ্গসংগঠন। অধিকাংশ মিছিলকারীরা বাইরে থেকে এসে টাকা নিয়ে ঝটিকা মিছিলে অংশ নেয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ডিএমপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দুর্বৃত্তরা হেলমেট ও মুখোশ পরে ভোরের দিকে বা ব্যস্ত সময়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। এমনকি কিশোরদেরও এসব কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি জানান, রাজধানী ও গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যৌথ অভিযান চলছে। গুলশান, ধানমন্ডি, বনানী ও মতিঝিল এলাকায় টহল বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে শহরের গির্জা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।