ইনু-মেননের মতো হতে চান না এনসিপি নেতারা,জোট নিয়ে বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক
মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া:আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নতুন করে আলোচনায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।দেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নেতা হাসানুল হক ইনু এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এক সময় স্বাধীন বামপন্থি দলের জনপ্রিয় নেতা হিসাবে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও এখন দল দুটির গুরুত্ব কমে গেছে। জোটের কারণে তারা কার্যত স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে সরে গিয়ে গত ১৫ বছর কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের গুণগানে মত্ত ছিলেন। এই মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দল দুটির আর কোনো আবেদন নেই। এ কারণেই বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে জোট করার বদলে যুগোপযোগী কর্মসূচির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ রাজনীতির শক্ত ভিত গড়ে তুলতে চাইছে এনসিপি।জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তি হিসাবে বিএনপি এবং জামায়াত উভয় দলই এনসিপিকে তাদের নির্বাচনি জোটে পেতে মরিয়া।এজন্য দুদলের পক্ষ থেকেই পর্দার আড়ালে এনসিপির সঙ্গে নানামুখী যোগাযোগ চলছে।তবে বড় দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে এনসিপি নেতারা পতিত ফ্যাসিস্টের অন্যতম সহযোগী হাসানুল হক ইনু কিংবা রাশেদ খান মেননের পরিণতি বরণ করতে রাজি নয়। অর্থাৎ বড় রাজনৈতিক জোটে যোগ দিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান হারাতে চায় না এনসিপি।
শুক্রবার রাতে বিএনপির এক নেতার বাসায় এনসিপির প্রথম সারির কয়েকজন নেতার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। সেখানে এনসিপি নেতারা উল্লিখিত মতামত দেন। তারা বলেন, আগামী নির্বাচনে ভোট যাই পাওয়া যাক এনসিপি রাজনীতির মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে চায়। কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করে তারা রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতে চায় না।
বৈঠক সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, বিএনপির পক্ষ থেকে এনসিপিকে ৮ থেকে ১০টি আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এনসিপি নেতারা এতে রাজি হননি। তারা সাফ জানিয়ে দেন আসন্ন নির্বাচনের আগে কোনো দলের সঙ্গে জোটে যাচ্ছে না এনসিপি। এমনকি জামায়াত বা তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক জোটও নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে দলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে আমরা পরিষ্কার করে বলেছি যখন কোনো ছোট দল অন্য কোনো বড় রাজনৈতিক দলে যোগ দেয় তখন তাদের মতাদর্শ হারিয়ে যায়। ফ্যাসিস্ট হাসিনার অন্যতম দোসর ইনু-মেননের দলগুলো এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে জনগণের কাছে তারা আওয়ামী সরকারের আজ্ঞাবহ এবং গৃহপালিত দল হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। এনসিপি সেই একই ভুল পথে পা বাড়াবে না।
তিনশ আসনে প্রার্থী : একাধিক দলের পক্ষ থেকে জোটে টানার আলোচনার মধ্যে এনসিপি তিনশ আসনেই প্রার্থী দিতে অনড়। ইতোমধ্যে খসড়া প্রার্থী তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। শুরু হয়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার। চলতি সপ্তাহেই এনসিপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে। তবে সরকারে থাকা দুই উপদেষ্টা-আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া ও মাহফুজ আলমের এনসিপিতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। এমনকি তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না তাও নিশ্চিত নয়।
এনসিপি নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ধরেই প্রার্থী নির্বাচনসহ অন্য দলীয় কার্যক্রম চালাচ্ছেন। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণভোট, সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি না হলে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারে এনসিপি। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত ফেব্রুয়ারি ডেটলাইন পিছিয়ে গেলে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনে জোটে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এবং দলের রাজনৈতিক কাউন্সিলের সদস্য আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, আসন্ন নির্বাচনে এনসিপি এককভাবে প্রার্থী দেবে। অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে যেতে দলের নেতাকর্মীরা রাজি নন। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম রাজনৈতিক কাউন্সিলেও জোটে না যাওয়ার পক্ষে মতামত এসেছে।
সূত্র জানায়, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী উভয় দলই জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তি হিসাবে এনসিপিকে জোটে পেতে মরিয়া। দুদলের পক্ষ থেকেই এনসিপির বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ চলছে। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় শুধু ক্ষমতার জন্য অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোটে না গিয়ে বরং নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখার পক্ষে এনসিপি।
এনসিপি নেতৃত্ব বলছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক নয়, বরং তারা জনগণের প্রত্যাশার রাজনীতি করতে চান। দীর্ঘ সময়ের জন্য তারা রাজনীতির মাঠে নেমেছেন। আসন্ন নির্বাচনে জয়-পরাজয় যেটাই হোক তারা সেটি মেনে নেবেন। এরপর নতুন করে গণমানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে তারা রাজনীতির মঞ্চে টিকে থাকবেন।
এনসিপি নেতারা মনে করেন, দেশের প্রচলিত দুই ধারার রাজনীতি জনগণের আস্থা হারিয়েছে। তাই এনসিপির সামনে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ক্ষমতার বাইরে থেকেই প্রভাবশালী বিকল্প শক্তি হিসাবে রাজনীতিবিমুখ তরুণ ও পেশাজীবী শ্রেণিকে রাজনীতিতে যুক্ত করার চেষ্টা চালাবে এনসিপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে জোটনির্ভর রাজনীতি আসলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ছোট দলগুলো বড় দলের সঙ্গে জোটে ভিড়ে যায় মূলত ক্ষমতার ভাগবাঁটোয়ারা বা মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে। কিন্তু তারা একপর্যায়ে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান এবং রাজনৈতিক পরিচয় হারিয়ে ফেলে। এনসিপি যদি সত্যি তাদের স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রাখতে চায় তাহলে ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে গিয়ে তারা কার্যকর বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারে।