আওয়ামী আমলের ওসিরা বহাল তবিয়তে ,শুধু থানা বদল
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া:শুধু এক থানা থেকে আরেক থানায় বদলি করে লোক দেখানো পরিবর্তন করা হয়েছে।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ঢাকার বাইরে থেকে বেশ কয়েকজনকে মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি)বিভিন্ন থানায় ওসি হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে।অথচ ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকার আমলে বঞ্চিত বিপুলসংখ্যক পরিদর্শক এখনো আগের অবস্থায় রয়েছেন।আওয়ামী আমলে দেশের বিভিন্ন থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসাবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও তাদের অনেকেই বহাল তবিয়তে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।আরও জানা গেছে, বর্তমান বাস্তবতায় ডিএমপির বেশ কয়েকজন ওসিকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ তালিকায় যেসব থানার ওসির নাম রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-কদমতলী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর, আদাবর, সবুজবাগ, ওয়ারী, তুরাগ, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, মিরপুর এবং তেজগাঁও। আর অভিযোগ ওঠায় ইতোমধ্যেই উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব, কলাবাগান এবং পল্লবী থানার ওসি পরিবর্তন করা হয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ওসি দায়িত্ব পালন করেছেন আমরা তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। আমাদেরও একটি লিমিটেশন আছে। আমরা তো সবাইকে বাদ দিতে পারব না। প্রথমে দেখব যারা তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করছেন, দ্বিতীয়ত, দুটি এবং তৃতীয়ত, একটি নির্বাচনে কারা দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমি চাইলেই তো নতুন ওসি নিয়ে আসতে পারব না। কেউ যদি একটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করে থাকে, আর যদি তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকে তাহলে তাকে দায়িত্ব দিতে সমস্যা নেই। চাইলেই তো ১০০ ওসি নিয়োগ দিতে পারব না।’ অনেক পুলিশ পরিদর্শক আছেন, যারা ওসি হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু অতীতে কখনো ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাননি। তাদের কেন দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না-যুগান্তরের এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী বলেন,ফ্যাসিবাদ আমলের কোনো ওসি ডিএমপিতে কর্মরত আছে কি না তা আমার জানা নেই। আপনার কাছ থেকে যেহেতু বিষয়টি জানলাম।খোঁজ নিয়ে দেখব।এ ধরনের কাউকে পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদের কাউকে রাখা হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,মোহাম্মদ আইয়ুব গত ২১ জানুয়ারি যোগদান করেন কদমতলী থানার ওসি হিসাবে। ২০২০ থেকে ২২ সালে তিনি দায়িত্ব পালন করেন কুমিল্লার লালমাই থানার ওসি হিসাবে। এর আগে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে তিনি ছিলেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার ওসি। তিনি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী আফম মোস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামালের আস্থাভাজন।এছাড়া কুমিল্লা কোতোয়ালি,চান্দিনা ও সদর দক্ষিণ থানার পরিদর্শক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।তিনি এসআই থাকাকালে ডিএমপির যাত্রাবাড়ী,ওয়ারী ও মতিঝিল থানায় কর্মরত ছিলেন বলেও জানা গেছে। লোটাস কামালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন,তার সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয়তার সংশ্লিষ্ট নেই। যেহেতু তার এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছি, তাই কাজের স্বার্থেই ভালো সম্পর্ক ছিল।
মাহমুদুর রহমান ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর যোগ দেন ডেমরা থানার ওসি হিসাবে। এর আগে তিনি চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও ভোলার বোরহানউদ্দিন থানার ওসি ছিলেন। মাহমুদুর রহমান বলেন, আমি চাকরি জীবনের বেশির ভাগ সময় পিবিআইয়ে দায়িত্ব পালন করেছি। আমি ২০১৭ সালে মাত্র পাঁচ মাস জীবননগর থানার এবং এক মাস বোরহানউদ্দিনের ওসি ছিলাম।
মো. কামরুজ্জামান গত ২৯ জানুয়ারি যোগ দেন যাত্রাবাড়ী থানার ওসি হিসাবে। এর আগে তিনি কুমিল্লা ব্যাঙ্গুরা বাজার থানা, মুরাদনগর থানা ও চট্টগ্রাম বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ ছিলেন। কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মো. আমিনুল ইসলাম গত সরকারের সময়ে ডিএমপির ডিবিতে কর্মরত ছিলেন। কামরাঙ্গীরচর এলাকায় তার একাধিক বাড়ি থাকার কথা চাউর রয়েছে।
পুলিশ পরিদর্শক রহিম মোল্যার বাড়ি কুষ্টিয়া সদরে। বিগত সরকারের সময়ে তিনি যশোর অভয়নগর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত), বাঘারপাড়া, ঝিনাইদহ হরিণাকুণ্ডু থানা ও মাগুরার শালিখা থানার ওসির দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি ‘খোলস’ পালটে ফেলেন। যোগদান করেন উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি হিসাবে। গত ৬ নভেম্বর তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সম্প্রতি সরিয়ে দেওয়া উত্তরা পূর্ব থানার বর্তমান ওসি গোলাম মোস্তফা খুলনার তেরখাদা ও সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন।
ওয়ারী থানার ওসি আব্দুর রউফ আগে ঝিনাইদহ হরিণাকুণ্ডু থানা, গুলশান থানার ওসি হাফিজুর রহমান আগে উত্তরা পশ্চিম থানায় ছিলেন। মোহাম্মদপুর থানার ওসি রফিক আহমেদ আগে শাহআলী থানায় ছিলেন। মিরপুর থানার ওসি সাজ্জাদ রোমান আগে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থানার ওসি ছিলেন।
শাহআলী থানার বর্তমান ওসি মো. আসলাম হোসেন গত ৫ এপ্রিল যোগদান করেন। এর আগে তিনি সিরাজগঞ্জ জেলায় ডিবির ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর সিরাজগঞ্জ জেলার একটি থানায় ওসির দায়িত্বে ছিলেন।
তুরাগ থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বাগেরহাট কচুয়া থানা ও ডিবির ওসি ছিলেন। আদাবর থানার ওসি এসএম জাকারিয়া ২০২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর যোগদান করেন। ফ্যাসিবাদ আমলে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার অফিসার ওসি এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ডিআইও-১ হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
জানা গেছে, মোহাম্মদপুর থানার ওসি রফিক আহমেদ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কক্সবাজার দোহাজারী হাইওয়ে থানা ও রামু হাইওয়ে থানার ওসি ছিলেন। সবুজবাগ থানার ওসি মো. ইয়াছিন আওয়ামী লীগ আমলে ডিএমপির কয়েকটি থানায় চাকরি করেন।
২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত নিউমার্কেট থানায় ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
এদিকে থানায় ওসির দায়িত্ব না পেয়ে কয়েকশ পুলিশ ইন্সপেক্টরের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিগত সরকারের সময়ে থানায় পোস্টিং পাওয়া অনেকে পটপরিবর্তনের পর নতুন করে ঢাকায় থানার দায়িত্ব পাওয়ায় বঞ্চিতরা ক্ষুব্ধ। বদলি ও পদোন্নতি নিয়ে বিবাদে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন এখন দুই ভাগে বিভক্ত।
ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পেয়ে এক যুগ পরও থানায় ওসির দায়িত্ব পাননি এমন সদস্য প্রায় ৩শ। থানায় ওসির দায়িত্ব পেতে পদস্থদের কাছে ধরনা দিয়েও কাজ হচ্ছে না তাদের। বয়স ৫৪ বছর হলে থানায় ওসির দায়িত্ব পাবে না বিগত সরকার যে অলিখিত বিধান করেছিল ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তা বাতিল হলেও ফের একই আদেশ কার্যকর করায় অনেকেই অসন্তুষ্ট।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো.সরওয়ার বলেন,ফ্যাসিবাদ আমলে ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী যেসব কর্মকর্তা ডিএমপিতে ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।এরই মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।তিনি বলেন,ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা থাকার পরও অতীতে যারা দায়িত্ব পাননি,ভবিষ্যতে তাদের সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা থাকবে।