দাম বাড়িয়ে মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানির পাঁয়তারা - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দাম বাড়িয়ে মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানির পাঁয়তারা


জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক,আলোকিত বার্তা :দেশের মাঠে যখন নতুন পেঁয়াজ তোলার প্রস্তুতি চলছে, ঠিক তখনই আমদানিকারক সিন্ডিকেট চালাচ্ছে নোংরা খেলা।কারসাজি করে এক সপ্তাহে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ৪০ টাকা বাড়িয়ে পেঁয়াজের দাম ১৪০ টাকায় ঠেলে দিয়েছে।মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৭০ টাকা।পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়িয়ে আমদানির অনুমতি নেওয়ার কৌশলে কৃষক ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে ভোক্তার প্লেটে আগুন ধরিয়ে উল্লাস করছে একদল মুনাফালোভী ব্যবসায়ী। কৃষক ঘামে ভেজা মাটিতে পরিশ্রম করলেও বাজারের দখল নিতে আগেভাগেই আমদানি ফাঁদ পেতেছে সেই চক্র।মৌসুম শুরুর আগেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ে ২ হাজার ৮০০টি ইমপোর্ট পারমিটের আবেদন জমা দিয়েছে।আর এই নাটক দেখছে নীরব প্রশাসন।বাজারসংশ্লিষ্টের মতে, প্রতিবছর এই সময় মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এবারও তারা দাম বাড়াচ্ছে। গত মৌসুমে কৃষকরা ন্যায্য দাম না পেয়ে সব পেঁয়াজ বিক্রি করে ফেলেছেন। ফলে এখন তাদের কাছে পেঁয়াজ নেই। তা অসাধু মজুতদারদের দখলে। এই সুযোগে মজুতদাররা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজ আটকে রেখে দাম বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে দাম বাড়ার অজুহাত তুলে ভারত থেকে আমদানির জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে।

পাবনার চাটমোহরের কৃষক বরকতউল্লাহ বলেন, আমরা কষ্ট করে মাঠে পেঁয়াজের আবাদ করছি। কিছুদিন পর নতুন পেঁয়াজ মাঠ থেকে তোলা হবে। বাজারে এসে যাবে নতুন পেঁয়াজ। আবাদে সব মিলে প্রতি কেজিতে ৪০ টাকার উপরে খরচ আছে। এখন যদি আমদানি করা পেঁয়াজ দেশে আসে আমরা ক্ষতির মুখে পড়ব। আবাদ খরচ উঠবে না। দেখা যাবে প্রতিবারের মতো এবারও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছ থেকে কম দামে পেঁয়াজ নিয়ে মজুত করবে। তাই সরকার আমদানি বন্ধ না করলে আমরা টিকতে পারব না। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার ও রামপুরা বাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদিন প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১২০-১৩০ টাকা। যা ৭ দিন আগেও ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা। তবে পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানে এই পেঁয়াজ ১৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।নয়াবাজারের নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. সোলাইমান শাওন বলেন, প্রতিবছর এই মাসে বিক্রেতারা পেঁয়াজের দাম বাড়ায়। এবারেও বাড়ানো হয়েছে। এটা তাদের নিয়মে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাজারে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। আপনি ১০ কেজি কিনতে চাইলেও কিনতে পারছেন। তাহলে বিক্রেতারা সরবরাহ সংকটের কথা বলে কিভাবে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। দেখার যেন কেউ নেই। সরকারের একাধিক উইং চোখে টিনের চশমা দিয়ে বসে আছেন।

রাজধানীর সর্ব বৃহৎ পাইকারি আড়ত শ্যামবাজারের পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার পাল্লা পেঁয়াজ (৫ কেজি) ৫২৫-৫৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেক্ষেত্রে কেজি হিসাবে মূল্য হয় ১০৫-১১৫ টাকা। যা এক মাস আগেও ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেক্ষেত্রে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম পাইকারি পর্যায়ে ৫৫-৬০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে।কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে আড়তদার, কমিশন এজেন্ট ও দাদন ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। তারা পেঁয়াজ কিনে মজুত করছে, বাজারে ছাড়ে না। দেশে ভালো উৎপাদন হলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমদানির পাঁয়তারা করছেন। মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানি হলে কৃষক ঠকবেন। আর এখন বাজারে নজরদারি না বাড়ালে ভোক্তার পকেট কাটা যাবে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বছরে ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা থাকলেও গত মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ টন। এবার সংরক্ষণ ভালো হয়েছে। এমন অবস্থায় নতুন করে আমদানির প্রয়োজন নেই। এখন দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি নেই। বরং পর্যাপ্ত মজুত আছে। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি। তবু কিছু ব্যবসায়ী আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা ইতোমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ে আইপি নিতে ২ হাজার ৮০০ আবেদন দিয়েছে। অথচ এক মাস পরই উঠবে দেশীয় পেঁয়াজ। যা বাজারে আরও সরবরাহ বাড়াবে।

মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুর রহমান বলেন, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নভেম্বরেই বাজারে আসবে। এখন আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করাই আমাদের প্রথম লক্ষ্য। আলুর মতো পেঁয়াজের দরপতন আমরা হতে দেব না। পাশাপাশি ভোক্তার খরচের দিকেও আমাদের নজর রাখতে হবে। সব মিলে বাজার তদারকি সংস্থাদের নজরদারি বাড়াতে হবে।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিলে দাম কিছুটা বাড়লে বাণিজ্য উপদেষ্টার পরামর্শে কৃষি মন্ত্রণালয় সীমিত আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। পরে দাম কমে গেলে নতুন কোনো আইপি দেওয়া হয়নি। এরপরও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে আইপি ছাড়া এলসি খুলে পেঁয়াজ আনার চেষ্টা করেছে। তবে অনেক পেঁয়াজ এখনো বন্দরে পড়ে আছে। আইপি না থাকায় এগুলো আটকে দেওয়া হয়েছে। তাই তারা বাজারে দাম বাড়িয়ে আমদানির জন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করছেন। আইপি না পেয়ে ব্যবসায়ীরা হাইকোর্টে ১৪টি রিট করেন। এর মধ্যে ৮টি ইতোমধ্যে আদালত খারিজ করে দিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের অতিরিক্ত উপপরিচালক (আমদানি) বনি আমিন খান বলেন, পেঁয়াজ আমদানির বিষয় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় অনুমতি না দিলে আইপি দেওয়া যায় না। পেঁয়াজ আমদানির জন্য ২ হাজার ৮০০-এর বেশি আবেদন পড়েছে। আমরা সব আবেদন ফেরত দিয়েছি।বৃহস্পতিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বাজারে পেঁয়াজের দাম কেন বেড়েছে তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিন পর্যায়ে দাম পর্যালোচনা করা হচ্ছে। হঠাৎ করে দাম বাড়ানোর পেছনে কারা দায়ী তা বের করা হচ্ছে। প্রমাণ মিললেই আইনের আওতায় আনা হবে।

Top