মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ কে নেবে,আধিপত্যে ঝরছে প্রাণ - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ কে নেবে,আধিপত্যে ঝরছে প্রাণ


জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক,আলোকিত বার্তা:মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ কে নেবে,সেই লড়াই এখন জীবন-মরণে রূপ নিয়েছে।গত এক বছরে এই আধিপত্যের সংঘাতে প্রাণ গেছে অন্তত ১০ জনের।সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ভোরে নিহত হন বুনিয়া সোহেল গ্রুপের সদস্য যুবক জাহিদ। তার মৃত্যুর পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ৩১ অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে অনেকটা নীরবতা ফিরেছে ক্যাম্পে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয় আর ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি ঘরে।রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এখন এক অঘোষিত অপরাধ সাম্রাজ্য।দিনরাত চলা ককটেলের শব্দ,গলিতে গলিতে উত্তেজনা যেন ক্যাম্প নয়, যুদ্ধের ময়দান।পুলিশ জানিয়েছে,জাহিদ হত্যার ঘটনায় পিচ্চি রাজা,চুয়া সেলিমসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ৪০-৪৫ জনকে আসামি করে শুক্রবার মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে।এই হত্যায় জড়িত চারজনকে পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে।

সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পে তিন গ্যাং-চুয়া সেলিম, পিচ্চি রাজা ও বুনিয়া সোহেলের মধ্যে আধিপত্যের দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে। গত ২১ অক্টোবর সেনাবাহিনীর অভিযানে পিচ্চি রাজা গ্রুপের আস্তানা থেকে ৩২টি তাজা ককটেলসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। এর পরদিন, প্রতিশোধ নিতে গিয়ে চার নম্বর সেকশনে বুনিয়া সোহেল গ্রুপের সঙ্গে পিচ্চি রাজা গ্রুপের সংঘর্ষ বাধে। এতে ককটেলের আঘাতে নিহত হয় বুনিয়া সোহেল গ্রুপের সদস্য জাহিদ।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি রফিকুল হক জানান,জাহিদ হত্যার ঘটনায় জড়িত চারজনসহ ২৭ জনকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও র‌্যাব-২ যৌথ অভিযান চালিয়ে জেনেভা ক্যাম্প থেকে আবদুল্লাহ সারমান, ইমরান হোসেন আলম, মো. সোহেল ও মো. আকাশকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে মো. সোহেল ‘বুনিয়া সোহেল গ্রুপের ম্যানেজার’ হিসাবে পরিচিত। অভিযানে উদ্ধার হয় একটি বিদেশি পিস্তল ও দেড় কেজি গাঁজা। অভিযান শেষে সেনা কর্মকর্তারা জানান, জেনেভা ক্যাম্পকে অপরাধমুক্ত করতে অভিযান অব্যাহত থাকবে। কেউ মাদক ব্যবসার ছত্রছায়ায় থাকতে পারবে না।

পুরুষশূন্য অলিগলি, আতঙ্কে নারীরা :শুক্রবার বিকাল ৪টা। জেনেভা ক্যাম্পের ১,২ ও ৩ নম্বর সেক্টরের গলিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে নিস্তব্ধতা। কোথাও নেই শিশুর কোলাহল, নেই আড্ডার শব্দ। দোকানপাটের শাটার অর্ধেক নামানো, চায়ের দোকান ফাঁকা। ৪ নম্বর সেকশনের একটি গলির শেষপ্রান্তে কয়েকজন নারীকে জানালার আড়াল থেকে আতঙ্কিত চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বাসিন্দা জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকেই পিচ্চি রাজা ও বুনিয়া সোহেল গ্রুপের লোকজন গাঢাকা দিয়েছে। পুরুষরা পালিয়েছে, নারীরা ঘরে বন্দি। পুলিশের সাইরেন শুনলেই সবাই দরজা বন্ধ করে দেয়।

বোমা-পিস্তল সহজ অস্ত্র : শুক্রবার বিকাল ৫টা। ক্যাম্পের ৪ নম্বর সেক্টরের বৃদ্ধা রহিমন বেগম পানি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। তিনি কাঁপাকণ্ঠে বলেন, যারা ক্যাম্পকে অশান্ত করছে, ওরা কোটি কোটি টাকার মালিক। এরা মানুষের রক্তের ওপর ভর করে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। আর সহিংসতা-সংঘাতের বলি হচ্ছে এখানকার সাধারণ মানুষ। হাজার-বারোশ’ অপরাধীর কাছে আমরা ক্যাম্পবাসী জিম্মি হয়ে আছি। তিনি বলেন, আগেও মারামারি হতো। তবে আগে শুধু লাঠিসোঁটা ছিল, এখন বোমা, পিস্তল, সামোরাই দিয়ে হামলা চালায় ওরা। আমাদের বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। রাত হলে কেউ বাইরে বের হয় না। আরেক বাসিন্দা রমজান বলেন, চুয়া সেলিম, পিচ্চি রাজা ও বুনিয়া সোহেল-এই তিন গ্রুপের সংঘর্ষে এক বছরে অন্তত ১০ জন মারা গেছে। বহু মানুষ আহত হয়েছে। পুলিশের মামলা হয়, অভিযান হয়। কিন্তু পরে আবার আগের মতোই শুরু হয়। সবাই জানে কারা অপরাধের নেতা! কিন্তু তারা ধরা পড়ে না।

বেশি কমিশনে দল ভারী : ক্যাম্পের এক তরুণ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই ক্যাম্প মাদকের মহাসমুদ্র। এখানে মাদক বিক্রি হয় প্রকাশ্যে। ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, সবকিছুর লেনদেন চলে খোলামেলা। যে বেশি কমিশন দেয়, ছোট বিক্রেতারা তার দলেই যায়। এ নিয়েই শুরু হয় মারামারি। শুক্রবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পের ‘বোবার বিরিয়ানি’র পাশের গলিতে দাঁড়িয়ে কথা হয় বাসিন্দা আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালায় ঠিকই, কিন্তু ক্যাম্পে কিছু সোর্স আছে। তারা পুলিশের হয়েও কাজ করে, আবার মাদক মাফিয়াদের কাছ থেকেও সুবিধা নেয়। এরা অভিযানের খবর আগেই পৌঁছে দেয়। ফলে মূল হোতারা পালিয়ে যায়।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় উত্থান : ক্যাম্পের ষাটোর্ধ্ব এক বাসিন্দা বলেন,আগে এই মাদক মাফিয়ারা আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে ছিল। এখন তারা অন্য এক প্রভাবশালী দলের নেতাদের কাছে ভিড়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া থাকায় কেউই তাদের স্পর্শ করতে পারে না। অভিযান হলে ধরা পড়ে কেবল ছোটখাটো বিক্রেতারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রও একই দাবি করছে।জেনেভা ক্যাম্পের মাদক চক্রের মূল ‘গডফাদাররা’ ক্যাম্পে থাকেন না। তারা বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন রাজনৈতিক প্রভাব ও টাকার জোরে।

পুরোনো সাম্রাজ্যের নতুন রূপ :জেনেভা ক্যাম্পের মাদক সাম্রাজ্যের ইতিহাস নতুন নয়। স্থানীয়দের ভাষায়, একসময় পুরো ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করত ‘পঁচিশ’ ও ‘ইশতিয়াক’ নামের দুই ‘মাদক সম্রাট’।তাদের মৃত্যুর পর নিয়ন্ত্রণ ভাগ হয়ে যায় কয়েকজনের হাতে। এখন অন্তত ১২ জন মাদকের নিয়ন্ত্রক।তাদের মধ্যে বড় মাফিয়া বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম ও পিচ্চি রাজা। তাদের হাতে এখন গড়ে উঠেছে নতুন প্রজন্মের গ্যাং। জেনেভা ক্যাম্পের একজন সমাজকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,১৬-১৭ বছর বয়সেই ছেলেরা গ্যাংয়ে ঢুকে পড়ে। কাজ বা পড়াশোনা নয়, এখন তাদের কাছে মাদকই টাকার উৎস আর ক্ষমতার প্রতীক।ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ইবনে মিজান বলেন, জেনেভা ক্যাম্প এলাকা খুব ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে অপরাধীরা সহজেই গাঢাকা দিতে পারে।আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। তিনি বলেন, মাদকের মূল ডিলাররা বাইরে থাকে। তারা ফোন ব্যবহার করে না। যে কারণে তাদের গ্রেফতার করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

Top