রাজস্বের বড় অংশ ঢুকছে ঘুস সিন্ডিকেটের পকেটে,‘শুঁটকির বাজারে বিড়াল চৌকিদার’
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :যাদের অনেকে দলিল লেখক,নকলনবিশ ও উমেদার।নেপথ্যে থাকেন সাবরেজিস্ট্রারসহ প্রভাবশালীরা।কোথাও আবার ঘুস-কমিশন সিন্ডিকেটের সদস্যরাই বেশি ক্ষমতাবান। বলা যায়, রক্ষকরাই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। শুঁটকির বাজার পাহারা দিতে বিড়ালকে চৌকিদার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোয় একদিকে যেমন সরকার তার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনই এ সুযোগে জাল-জালিয়াতিসহ জনহয়রানির মাত্রা বাড়ছে বৈ কমছে না। বেশির ভাগ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে সরকারি রাজস্ব খেয়ে ফেলছে দুর্নীতিপরায়ণ একশ্রেণির কর্মচারী। তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে দুই মাসের অনুসন্ধানে এসব বিষয়ে হাতে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্যপ্রমাণ এসেছে। আজকের পর্বে উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ৮টি দলিলের পোস্টমর্টেম তুলে ধরা হলো।
তথ্যানুসন্ধান অনুযায়ী উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে বেপরোয়াভাবে ঘুস-দুর্নীতি শুরু হয় মূলত সাবেক সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লার সময় থেকে। এরপর থেকে বেশির ভাগ দলিলে সরকারের ভ্যাট ও উৎসে কর (১২৫ ও ১২৬ ধারা) ঢুকছে ঘুসচক্রের পকেটে। মিথ্যা তথ্য আর জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মাত্র ৮টি দলিল বিশ্লেষণ করে যুগান্তরের অনুসন্ধানে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়েছে। গত তিন বছরের দলিল যাচাই-বাছাই করা হলে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি ধরা পড়তে পারে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রকৃত রাজস্ব ফাঁকি দিতে বায়না দলিল গোপন রেখে সাফ কবলা দলিলে সম্পত্তির মূল্য অনেক কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেছে। এর ফলে এক দলিলেই সরকার সোয়া তিন কোটি টাকা কম রাজস্ব পেয়েছে। এর বিনিময়ে চক্রটি দুই দফায় ঘুস নিয়েছে কোটি টাকা। অপরদিকে একটি দলিলের পাতা পরিবর্তন করে মোটা অঙ্কের উৎসে কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একই ভবনে থাকা ১টি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রির সময় উৎসে কর ও ভ্যাট নেওয়া হলেও বাকি ৪টি দলিলে নেওয়া হয়নি।
কেস স্টাডি-১ : বায়না দলিল মূল্য গোপন করে সোয়া তিন কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি
গত বছর ১২ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশনে একটি বায়না দলিল সম্পন্ন করে উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিস। দলিল নম্বর-১১৭৫২। বায়না দলিল মূল্য ধরা হয় ২২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এরপর এই সম্পত্তি সাফ কবলা হিসাবে রেজিস্ট্রি করা হয় ৬ মার্চ। যার দলিল নম্বর ২৫১২। সেখানে আগের বায়না দলিলের তথ্য গোপন করে সম্পত্তির দাম ধরা হয় ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে সরকারের মোট রাজস্ব আদায় করা হয় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৩২ টাকা। দুই দলিলে টাকা আদায়ের পার্থক্য হিসাব করলে দেখা যায়, প্রাপ্যতার চেয়ে সোয়া ৩ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। দলিল গ্রহীতাকে এই সুবিধা দিতে গিয়ে অলিখিতভাবে তিন ভাগের একভাগ কমিশন বাবদ ঘুস নেওয়া হয় ১ কোটি টাকা। ঘুসের ভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধের সূত্র ধরে বিষয়টি প্রতিবেদকের কাছে আসে।
সাফ কবলা দলিলে ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৩২ টাকা রাজস্ব আদায়ের মধ্যে নেওয়া হয় রেজিস্ট্রেশন ফি ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৩২, স্ট্যাম্প শুল্ক ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০, স্থানীয় সরকার কর ২ লাখ ৪৬ হাজার এবং জমির মূল্যের কাঠাপ্রতি ৫% হিসাবে উৎসে কর ১০ লাখ টাকা। কিন্তু দলিলে স্থাপনার মূল্য ৭৩ লাখ টাকা ধরা হলেও এ বাবদ ৮% হারে উৎসে কর নেওয়া হয়নি। উৎসে কর সংশোধিত বিধিমালা ২০২৪ এর ৬(২)-এর উপবিধি-১(১) অনুযায়ী বাড়ির স্থাপনার ওপর ৮% উৎসে কর দিতে হবে। ফলে স্থাপনার উৎসে কর হিসাবে আরও ৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা দিতে হবে, যা আদায় করা হয়নি।
এদিকে বায়না দলিলের ২২ কোটি ৭০ লাখ টাকা মূল্য হিসাবে সাফ কবলা দলিলে সরকারকে বিভিন্ন খাতে রাজস্ব দিতে হবে ৩ কোটি ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৫৩২ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে রেজিস্ট্রি ফি (দলিলের মোট মূল্যের ১%)+(ই+এন) ফিসসহ ২২ লাখ ৭০ হাজার ৫৩২, স্ট্যাম্প শুল্ক (দলিলের মোট মূল্যের ১.৫%) ৩৪ লাখ ৫ হাজার, স্থানীয় সরকার কর (দলিলের মোট মূল্যে ২%) ৪৫ লাখ ৪০ হাজার, জমির মূল্যের ওপর ৮% হিসাবে উৎসে কর ১ কোটি ৮১ লাখ ৬০ হাজার এবং ২% হিসাবে ভ্যাট ৪৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই দলিলে তা নেওয়া হয়নি।
আলোচ্য জমিটি উত্তরা বাইলজুরি মৌজার উত্তরা আবাসিক এলাকার ১৩নং সেক্টরে গরীব-ই-নেওয়াজ অ্যাভিনিউ রাস্তার ৫৪নং প্লটের ৫ কাঠা বা ৮.২৫ শতাংশ জায়গা। যার ওপর স্থাপনা হিসাবে দোতলা বাড়ি রয়েছে। প্রতি তলার আয়তন ২২২ বর্গমিটার। এখানে বায়না রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হওয়ার সময় দাতা গং চেকের মাধ্যমে প্রায় ১০ কোটি টাকা গ্রহণ করেছেন মর্মে তথ্য দলিলে উল্লেখ রয়েছে। বাকি টাকা কতদিনের মধ্যে কীভাবে পরিশোধ করা হবে, তার বর্ণনাও আছে। এদিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সূত্র জানায়,বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করায় ঘুস সিন্ডিকেটের ওপর অবশিষ্ট রাজস্ব আদায়ের জন্য সাবরেজিস্ট্রার মো. তৌহিদুল ইসলাম চাপ প্রয়োগ করেন। এরপর গত সপ্তাহে তারা বাড়ির স্থাপনার ওপর কম আদায় করা ৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা জমা দিয়েছেন। কিন্তু এখনো অনাদায়ি রয়েছে ৩ কোটি টাকার বেশি।
কেস স্টাডি-২ : দলিলের পাতা পরিবর্তন করে উৎসে কর ফাঁকি
উত্তরা আবাসিক এলাকায় ফায়দাবাদ মৌজায় ৭নং সেক্টরের ৯নং রোডের ২নং প্লটে বাড়িসহ ৫.২৮৭৫ কাঠা জমি। মোট দাম ৩ কোটি টাকা। কমিশনে সাফ কবলা দলিল নম্বর ৬৪৪৮, তারিখ ১৬ ও ১৭ জুলাই ২০২৫। এই দলিলে তফশিলের পাতা পরিবর্তন করে জমির মূল্য বেশি এবং স্থাপনার মূল্য কম ধরা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী এই দলিলে মোট আদায় করার কথা ৩২ লাখ ৯২ হাজার ২৬৬ টাকা। কিন্তু দুই দফায় আদায় করা হয়েছে ২০ লাখ ৬৮ হাজার ৬৫৭ টাকা। এখনো ১২ লাখ ২৩ হাজার ৬০৯ টাকা সরকারের পাওনা রয়েছে। প্রসঙ্গত, যুগান্তর এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করলে ৩১ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬৫৭ টাকা আদায় করা হয়। এর আগে দলিল রেজিস্ট্রির দিন ১৬ জুলাই উৎসে কর (ধারা ১২৫) আদায় করা হয় ১৫ লাখ টাকা।
সূত্রমতে, এ ধরনের ক্রাইম করতে গিয়ে দলিলের তফশিল সংশ্লিষ্ট পাতা পরিবর্তন করে উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দালাল সিন্ডিকেট। ১৩নং কলামে হস্তান্তর সম্পত্তির পরিমাণ কমবেশি করে তারা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। আর এটি করতে গিয়ে চক্রটি দলিল গ্রহীতার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুস নেয়।
কেস স্টাডি-৩ : তথ্য গোপন করে একই ভবনের একটি ফ্ল্যাটে উৎসে কর ভ্যাট আদায় করা হলেও বাকি ৪টি ফ্ল্যাটে তা নেওয়া হয়নি। ৮ থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে একটি ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য সাফ কবলা দলিল করা হয়। যার নম্বর ৭৫৩০। এখানে আইন মোতাবেক মেনে উৎসে কর (১২৬ ধারা) ৩ লাখ ৫ হাজার ১৭৫ এবং ভ্যাট আদায় করা হয় ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৫০ টাকা। কিন্তু একই ভবনে মাত্র একদিন আগে আরও ৪টি ফ্ল্যাট সাফ কবলা রেজিস্ট্রি করা হলেও সেখানে সরকারের প্রাপ্য উৎসে কর (১২৬ ধারা) ও ভ্যাট আদায় করা হয়নি। দলিল নম্বর-৭৫০৬, ৭৫০৭, ৭৫০৮ ও ৭৫০৯ (তারিখ ০৭-০৮-২০২৪)।
এখানে সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ঘুস আদায় করতে অভিনবভাবে দুটি পন্থা অবলম্বন করা হয়। প্রথমত, যথাযথভাবে উৎসে কর ও ভ্যাট আদায় সংক্রান্ত দলিলটি ইচ্ছাকৃতভাবে কমিশন করা হয়েছে। যাতে তদন্ত হলে সাবরেজিস্ট্রার বলতে পারেন, কমিশন হওয়ার কারণে তিনি ওই দলিলের বিষয়টি জানতেন না।অপরদিকে প্রায় প্রতিটি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে মোটা অঙ্কের ঘুস আদায়ের জন্য একটি কমন ফরমুলা ব্যবহার করা হয়। সেটি হলো কো-ডেভেলপার সংক্রান্ত বিষয়গুলো কৌশলে দলিলে উল্লেখ না করে দেখানো হয় দাতা নিজেই ভবন নির্মাণপূর্বক তার ব্যবহৃত ফ্ল্যাটটি বিক্রি করছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি যে ফ্ল্যাট বিক্রি করছেন, সেটি ডেভেলপারের কাছ থেকে পাওয়া অব্যবহৃত ফ্ল্যাট। আর আইনের ভাষায় অবশ্যই এক্ষেত্রে আয়কর আইন ২০২৩-এর ১২৬ ধারা প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ এ ধারা বলে তাকে উৎসে কর দিতে হবে। তবে জমিটি রেজিস্ট্রি করার সময় দাতা-গ্রহীতাকে এ বিষয়টি জানানোর সময় দালালচক্র ঘুস আদায়ের ফাঁদ পাতে। তারা জানিয়ে দেয় মোট উৎসে করের তিন ভাগের এক ভাগ ঘুস দিলে সিস্টেম করে দলিল রেজিস্ট্রি করে দেবে। আর অলিখিত এই সিস্টেমেই প্রতিদিন সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে, বিপরীতে প্রাপ্য রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ ঢুকছে এসব ঘুস সিন্ডিকেটের পকেটে।
ঘুস-সিন্ডিকেটের সদস্য যারা : তথ্যানুসন্ধান ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ঘুস নেওয়া চক্রের সঙ্গে জড়িতরা হলেন উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের একজন প্রভাবশালী নকলনবিশের আত্মীয় দলিল লেখক মো. উত্তম, সাবেক সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লার ক্যাশিয়ার খ্যাত ঝাড়ুদার মঞ্জু, নকলনবিশ মারুফ আহমেদ সাগর, নকলনবিশ মো. শহীদ, নকলনবিশ শাজাহান, নকলনবিশ সমিতির সভাপতি ফিরোজ, নকলনবিশ সুমন ও কনক। এছাড়া দলিল লেখক আব্দুর রহমান (গুলশান-সনদ নং-১৬৫)। কিন্তু তারা সবাই কাজটি করেছেন খুবই সূক্ষ্মভাবে নিজেদের খাতাকলমে প্রমাণ রাখার বাইরে।
সূত্র জানায়, উৎসে করের পে-অর্ডার জমা নেওয়ার দায়িত্বে থাকা নকলনবিশ শাজাহান ও কনক দলিলপ্রতি মোটা অঙ্কের ঘুস নেওয়া অব্যাহত রেখেছেন। তারা দলিল রেজিস্ট্রির সময় দাতা-গ্রহীতাদের প্রস্তাব দেন, জমির দাম একটু বেশি দেখিয়ে স্থাপনা কম দেখালে পে-অর্ডারে টাকা কম দিতে পারবেন। তবে এ সুযোগ নিতে গেলে অফিস খরচ বাবদ সাশ্রয় করা টাকার তিন ভাগের এক ভাগ অগ্রিম দিতে হবে। এ দুজনকে ঘুস নেওয়ার অভিনব এ পন্থা শিখিয়েছেন সাবেক সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা।শহীদ ও সুমন বায়না দলিলের রেজিস্টার সংরক্ষণ করেন। তবে যে বায়না দলিলকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সিস্টেম করা হয়, সেই বায়না দলিল কৌশলে রেজিস্টার খাতায় এন্ট্রি করা হয় না। এ সুবাদে সাফ কবলা দলিল করার সময় বায়না দলিলের তথ্য গোপন করা সহজ হয়।সাগর রাজউকের লিজ দলিল ও চিঠিপত্র সংরক্ষণ করেন। কোনো ঝামেলার দলিল পার করতে হলে রাজউকের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ করে ‘সিস্টেম’ করার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
এ চক্রের প্রত্যেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক। অনেকের ঢাকায় ফ্ল্যাট ছাড়াও বাড়ি রয়েছে। কেউ কেউ দামি গাড়ি অদূরে রেখে সাধারণ পোশাকে আসেন। অথচ অফিস নির্দেশনা অনুযায়ী একজন নকলনবিশের কর্মদিবসে কমপক্ষে ৩০০ শব্দ অথবা ১২ পাতা দলিল লিখে বালাম বহিতে তোলার কথা। এর বিনিময়ে তারা পাতাপ্রতি ৩৬ টাকা হিসাবে ৪৩২ টাকা পাবেন। এর চেয়ে কেউ বেশি লিখতে পারলে বেশি পাবেন। তবে একদিনে কারও পক্ষে সর্বোচ্চ ৩০ পৃষ্ঠার বেশি লেখা সম্ভব হয় না। তর্কের খাতিয়ে যদি ধরে নেওয়া হয়, আরও বেশি লিখতে পারবেন, সেক্ষেত্রে মাসে ৬০ হাজার টাকার বেশি আয় হওয়ার কথা নয়। অথচ তাদের বেশির ভাগ কোটিপতি তো বটেই, অনেকে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। একই চিত্র দলিল লেখকদের ক্ষেত্রে। মূলত তাদের আসল কাজে মনোযোগ নেই। এভাবে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার দালালি ও সিস্টেম করে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করেন। এই একই কাজ করে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের উমেদার থেকে ঝাড়ুদারও এখন কোটিপতি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে এ চক্রের অনেকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। কেউ খুদেবার্তা দেখেও কথা বলতে চান না। অনেকে সিম পরিবর্তন করে ফেলেন। তারা একাধিক সিম ব্যবহার করেন। কেউ শুরু করেন রিপোর্ট বন্ধের তদবির। তবে তাদের মধ্যে কথা বলা সম্ভব হয়েছে দলিল লেখক মো. উত্তম ও নকলনবিশ শাজাহানের সঙ্গে। উভয়ে অভিযোগ অস্বীকার করেন। উত্তম বলেন, ‘এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আমি অফিসের বাইরের লোক। দলিল করে চলে যাই। শাজাহানের দাবি সব মিথ্যা।’ দলিল লেখক আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ১০ বছর আগে কাজ ছেড়ে দিয়েছি। কেউ হয়তো আমার নাম ব্যবহার করেছে।’
আইওয়াশ অডিট : সাবরেজিস্ট্রি অফিসের রাজস্ব ফাঁকি সংক্রান্ত বিষয়াদি সরেজমিন নিরীক্ষা করে সরকারের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের নির্ধারিত টিম। অডিটর অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার মুহাম্মদ আলী আকবরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে চার দিনব্যাপী উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি নিরীক্ষা করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। রহস্যজনক কারণে এই টিমও এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলী আকবর বক্তব্য দেবেন বলে একদিন সময় নেন। কিন্তু এরপর তিনি কল রিসিভ করেননি। সূত্র বলছে, বিশেষ সুবিধা নিয়ে ইতোমধ্যে অডিট টিমও ম্যানেজ হয়ে গেছে। হয়তো শেষ পর্যন্ত কোনো আপত্তি না দিয়ে একটা আইওয়াশ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
যা বললেন সাবরেজিস্ট্রার :উল্লিখিত তথ্যানুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা সাবরেজিস্ট্রার মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন,মঝেমধ্যে মন চায় চাকরিটা ছেড়েই দেব।আর ভালো লাগে না। এ সার্ভিসের ইমেজ সংকট এতটায় বেশি যে, কোথাও পরিচয় দিতে পারি না।তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্য। পুরো ঘটনায় আমি বিব্রত ও সংক্ষুব্ধ। তবে কাউকে ছাড় দেব না। ইতোমধ্যে টাকা আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।এদিকে নীলফামারীর জলঢাকায় কর্মরত উত্তরা অফিসের সাবেক সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা বলেন,কাজ করতে গেলে কিছু ভুলত্রুটি হতে পারে। তবে তা ইচ্ছাকৃত নয়। অফিস স্টাফরা ঠিকমতো সহযোগিতা না করলে সব ভুল ধরা সম্ভব না। একটা অফিসে আমরা বড়জোর কাজ করি ১/২ বছর। কিন্তু অফিস চিনতে সময় লাগে ছ মাস।
প্রসঙ্গত, লুৎফর রহমান ধানমন্ডিতে থাকাবস্থায় ভুয়া দাতা দিয়ে দলিল করে ফেঁসে যান। ওই সময় তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়। যে মামলায় দলিল লেখক সমিতির নেতাও আসামি ছিলেন। অল্প কিছুদিন গুলশানে দায়িত্ব পালনকালে সেখানেও সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কয়েকটি দলিল করেন, যা নিয়ে তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।