ঐতিহাসিক দলিলে স্বাক্ষর আজ
মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া:আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের বহুল আকাক্সিক্ষত দলিল ‘জাতীয় জুলাই সনদ ২০২৫’। সংবিধানে আইন স্বীকৃতি দেয়ার অঙ্গীকারে প্রণীত ঐতিহাসিক এই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে।আর জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন এমন সৌভাগ্যবানরাও ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকবেন।ক্যালেন্ডারের পাতায় ইতিহাস হয়ে আছে ‘৫ আগস্ট’ তারিখ। ২০২৪ সালের এই দিনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ নতুনভাবে পথযাত্রা শুরু করে। সেই ৫ আগস্টের পথ ধরে ক্যালেন্ডারের পাতায় ‘১৭ অক্টোবর’ ‘ঐতিহাসিক তারিখ’ হতে যাচ্ছে। এদিন (আজ) শুক্রবার স্বাক্ষরিত হবে যেমনটা স্বাক্ষী হয়ে রয়েছেন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের বিজয় ও পাকিস্তানের পরাজয় স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা মানুষজন। আর যারা দলীয় স্বার্থের গ-ির কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ দলিলে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকবেন জাতির কাছে তারা ‘গণতন্ত্রবিরোধী’ তকমা পাবেন। এমনকি ঐতিহাসিক এ সনদে স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকলে তাদের হিন্দুত্ববাদী ভারত ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাম ধারার কয়েকটি দল সনদে স্বাক্ষর করবে নাÑ এমন খবর ছড়িয়ে পড়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা দলগুলোর বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও দিল্লির ফাঁদে পা দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন। কেউ কেউ বলছেন, দিল্লি অখুশি হবে এমন ভাবনা থেকে ওই দলগুলো সনদে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে বেশির ভাগ নেটিজেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ অনুগত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচিত বাম ধারার সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে না। সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, জুলাই সনদের প্রথম অংশে পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি, বারবার সংশোধনী দিলেও সেগুলো সন্নিবেশিত করা হয়নি। সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানে ৬ষ্ঠ তফসিলে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ এবং ৭ম তফসিলে থাকা ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি, তা বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না। অথচ জুলাই সনদ সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে; পটভূমিতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার কথা আগে পাঠানো খসড়া সনদে উল্লেখ থাকলেও চূড়ান্ত সনদে ১০৬ অনুচ্ছেদের কথা বাদ দেওয়া হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
গণফোরাম জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত টেলিগ্রাম এবং ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত থাকবে এটি নিশ্চিত করা না হলে তারা স্বাক্ষর করবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর আজকের স্বাক্ষরিতব্য ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’ ৬টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তিন ধাপে প্রায় আট মাস ধরে আলোচনার মাধ্যমে প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আজ বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই ঐতিহাসিক আয়োজনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত থাকবেন। সেই সঙ্গে এ আয়োজনে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, বিদেশি রাষ্ট্রদূত, বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা ও উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কি হয় তা দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছে দেশের কোটি কোটি মানুষ।
জেএসডি সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আ স ম আবদুর রব বলেছেন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে কর্তৃত্ববাদী কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম ধাপ জুলাই সনদ। এর মাধ্যমে যতটুকু অর্জন সম্ভব হয়েছে তা অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। রাষ্ট্র রূপান্তরের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে জুলাই সনদকে গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই জাতীয় স্বার্থে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।
তবে বিএনপি, জামায়াতসহ বেশির ভাগ দলই সনদে স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিলেও জনসমর্থন নেই এমন কিছু দল স্বাক্ষর করবে না বলে বার্তা দিয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদের চিত্র তুলে ধরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘এই ঐতিহাসিক সনদ স্বাক্ষরের ফলে রাষ্ট্র সংস্কারের এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের অব্যাহত ধারার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একটা নির্দিষ্ট অঙ্গীকারে পৌঁছবে। সেই সঙ্গে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে এই জাতীয় সনদ একটি দিকদর্শন হিসেবে কাজ করবে’। জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ ইতিহাসের দলিল। হিন্দুত্ববাদী ভারতের নাচের পুতুল মনস্টার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে বাংলাদেশকে নতুন ধারায় পরিচারিত করার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে এই দলিলকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে আইনি স্বীকৃতি দেয়া হবে এমন অঙ্গীকার করবেন রাজনৈতিক দলগুলো। এই দলিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ উপেক্ষা করে জাতীয় স্বার্থে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও দলটির রাজনৈতিক খুঁটি হিন্দুত্ববাদী ভারতের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐকবদ্ধ থাকতে অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশের পথচলা শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে। ঘোষণা দেয়া হয় সংস্কার কার্যক্রম করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেয়া হবে। ইতোমধ্যেই আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বার্তা দেয়া হয়েছে। সর্বত্রই চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একসঙ্গে চলছে অনুযায়ী সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা হয়। সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং জুলাই সনদ প্রণয়নের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলা হয়, ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লগি-বৈঠা তা-বে দেশে কয়েকটি নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকা- সংঘটিত হয়; এবং সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ও একটি অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১/১১ সরকার নামে পরিচিত। যার ফলে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করতে থাকে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের নীলনকশায় তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা ও হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সংঘটিত হয় এক নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে বিশেষ ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠী বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর তিনটি বিতর্কিত ও প্রহসনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস এবং বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ব্যবস্থা কায়েম করে। বস্তুতপক্ষে, রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অবারিত সুযোগ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিগত ১৬ বছরে দলীয় প্রভাবকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর, জবাবদিহিতাবিহীন ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিতে কোটা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের এক দফা আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-শ্রমিক-নারী-পেশাজীবী তথা ফ্যাসিস্টবিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সকল স্তরের জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে রেমিট্যান্স বন্ধ করাসহ অব্যাহতভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সফল এই অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত লগ্নে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা স্বৈরাচার হাসিনার পতন ত্বরান্বিত করে। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ সহস্রাধিক নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ গুরুতর আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি, ত্যাগ এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে অনেকেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় জনগণের মননে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের এক প্রবল আকাক্সক্ষার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটে; বিশেষত সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, ধসে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনি ও বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক ও পুলিশিব্যবস্থা এবং দুর্নীতি দমন ও জবাবদিহির ব্যবস্থায় সর্বত্র ব্যাপক সংস্কারের জোরালো আওয়াজ ওঠে। এই প্রেক্ষাপটেই গণঅভ্যুত্থানের সরকার প্রথম দফায় বিষয়ভিত্তিক ৬টি পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত বছর বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি কমিশন গঠন করা হয়। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনার জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে এ কমিশন প্রায় আট মাস ধরে তিন ধাপে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’ প্রণয়ন করে। এর আগে ১৬ আগস্ট রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো পূর্ববর্তী খসড়ায় কিছু ত্রুটি থাকায় তা সংশোধন করে নির্ভুল খসড়া প্রেরণ করা হয়। এরপর ২০ আগস্ট কমিশনের পক্ষ থেকে খসড়াটির ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর যেকোনো ধরনের মতামত প্রদানের সময় ২২ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সবার মতামত পর্যালোচনা করে এবং নির্ভুল আকারে জুলাই সনদ লিখিত আকারে চূড়ান্ত করে গত ১৪ অক্টোবর সনদের চূড়ান্ত কপি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে তুলে দেওয়া হয়। অতঃপর ১৫ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শেষ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। তবে ওই বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা স্পষ্ট হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদের দলীয় স্বার্থের গ-িতে থেকে সনদ নিয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান তুলে ধরেন। ওই বৈঠকের পর দলগুলোর নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে তাদের অবস্থানই তুলে ধরেন। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সনদে সই করার সম্মতি দিলেও জনসমর্থন নেই এমন কিছু দল সনদে সই না করার ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত এনসিপির নেতারা ‘নতুন বাহানা’ ধরে আইনি ভিত্তি ছাড়া স্বাক্ষর না করার ইঙ্গিত দেন। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দাবির ফ্যাকরা তোলেন। আর জনসম্পর্কহীন কয়েকটি বাম দল সনদে স্বাক্ষর করবে না জানিয়ে দেয়। তবে জুলাই জাতীয় সনদ বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবেই। আগামী নির্বাচন জুলাই জাতীয় সনদেরই অংশ’।
জুলাই সনদে স্বাক্ষরের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করতে বিএনপি প্রস্তুত। আশা করি, যেভাবে নোট অব ডিসেন্ট-এর বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছি সেভাবে আমরা স্বাক্ষর করি। তাহলে আমরা বিশ্বের কাছে নজির স্থাপন করতে পারব। দেশে এমন একটি পরিবেশ বজায় রাখতে হবে যেন পতিত স্বৈরাচার আর কখনো সুযোগ নিতে না পারে। জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা ১৭ তারিখের জুলাই সনদে স্বাক্ষরের আয়োজনে দাওয়াত পেয়েছি। যে সমস্ত বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি এবং এনসিসি সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সে সমস্ত বিষয়গুলো এক করে একটা প্যাকেজের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। শঙ্কা আছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া খোলাসা না করে জুলাই সনদ টেকসই করা সম্ভব কি না। অস্পষ্টতা থাকলে অর্জন অনিশ্চিত থেকে যাবে। জনগণকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া স্পষ্ট করে দেখাতে হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেবো স্বাক্ষর করব কি না।
আগামী নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির দাবি করে গতকাল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আইনি ভিত্তি ছাড়া কোনো নাটকীয়তায় অংশ নেবে না এনসিপি। স্বাক্ষরের আগেই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ায় দলগুলোর ঐকমত্য হতে হবে। এর ওপর ভিত্তি করেই আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টা বিবেচনা করব। আদেশের টেক্সটের খসড়া আমরা আগে দেখতে চাই। প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তিতে সরকার গঠন করেছেন, সেই জায়গা থেকে সেটা প্রেসিডেন্ট নয় বরং সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি সেটি জারি করবেন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কোনো পরিষ্কার ধারণা দেয়া হয়নি দাবি করে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, আদেশ, গণভোট এবং সংসদকে সাংবিধানিক ক্ষমতা দিতে হবে। কিন্তু সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া উল্লেখ করা হয়নি। নোট অব ডিসেন্ট বাস্তবায়ন কীভাবে তাও খোলাসা করা হয়নি। আদেশটা কেমন হবে, তাও খোলাসা নয়। এটি প্রধান উপদেষ্টার জারিকৃত আদেশ হতে হবে। গণভোটের প্রশ্নেও অস্পষ্টতা রয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন আগেই বলেছে সনদ স্বাক্ষরের পর বাস্তবায়নের সুপারিশ যত দ্রুত সম্ভব সরকারকে দেবে। আমরা আশা করি, তারা সনদে স্বাক্ষর করবে। জুলাই জাতীয় সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে মাত্র একটিতে এনসিপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। তাদের এই অবস্থানকে ইতিবাচক বলে মনে করে কমিশন। কারণ, দলটি চায় আগামী নির্বাচনে ১৫ শতাংশ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচন, যেখানে কমিশনের প্রস্তাবে ৫ শতাংশ আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবে যেসব সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তাদের ভিন্নমত নেই। এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এটা দুঃখজনক।