হাসিনা ও কামালের মৃত্যুদণ্ডের আবেদন
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপরাধের ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘প্রাণভোমরা’ ছিলেন। তার নির্দেশেই অন্য সহযোগীরা জুলাই আন্দোলনে গণহত্যা চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, যা ক্ষমার অযোগ্য। এজন্য শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। বৃহস্পতিবার টানা পাঁচ দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।একই সঙ্গে তিনি বলেন, এ মামলায় রাজসাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দেওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ঘটনা সম্পর্কে পূর্ণ সত্য প্রকাশ করেছেন জবানবন্দিতে। তার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটা ট্রাইব্যুনাল বিবেচনায় নেবেন। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ আবেদন জানান তিনি। এদিন জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে টানা পাঁচ দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে প্রসিকিউশন।
পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার জন্য প্রস্তুতি নিতে এক সপ্তাহ সময় চান। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য সোমবার দিন ধার্য করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য হলেন বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এদিকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ১৭ বছরের গুম-খুনের প্রত্যেক ভিকটিমের জন্য একবার করে বিচার করলে কেয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে না। এদিন চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে ৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দেন তিনি।
শেখ হাসিনার মামলায় শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১৪০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। একজন মানুষকে হত্যার জন্য যদি একবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে ১৪০০ জনকে হত্যার দায়ে শেখ হাসিনাকে ১৪০০ বার ফাঁসি দিতে হবে। কিন্তু আইনে এটা সম্ভব নয়। এজন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আমরা তার চরম দণ্ড দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি। যদি তাকে এ দণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে ন্যায়বিচার পাবে দেশের জনগণ।তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ থেকে অপরাধ সংঘটনের পর পালিয়ে গেলেও ভারত থেকে ক্রমাগত আন্দোলনকারীদের হত্যার হুমকি দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। যারা বিচার চেয়ে মামলা করেছেন, তাদেরও নির্মূলের কথা বলেছেন। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, এত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার পরও তার মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা নেই। তিনি একজন ‘হার্ডেনড ক্রিমিনালের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সুতরাং এই ট্রাইব্যুনালের মামলায় তিনি যেহেতু সব অপরাধীর প্রাণভোমরা ছিলেন, তাই তাকে আইনানুযায়ী চরম দণ্ড দেওয়া শ্রেয়। তাকে যদি চরম দণ্ড না দেওয়া হয়, এটা অবিচার করা হবে।
আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাং অব ফোর’-এর সদস্য ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তার বাসায় বসে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ড্রোন ওড়ানোসহ হেলিকপ্টার থেকে মারণাস্ত্র ছোড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি নিজে গ্রাউন্ডে গিয়ে গিয়ে দেখেছেন সঠিকভাবে হত্যা করা হচ্ছে কি না। তাকে ভিডিও দেখানো হয়েছে। তিনি কমান্ড স্ট্রাকচারে দ্বিতীয় পজিশনে ছিলেন। এ কারণে তার ব্যাপারেও চরম দণ্ড প্রযোজ্য। তবে রাজসাক্ষী হয়ে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন যেহেতু আইন অনুযায়ী আদালতকে তথ্য দিয়েছেন বা সত্য উদ্ঘাটনে সাহায্য করেছেন, তার ব্যাপারে আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন। এছাড়া যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন, তারা হয়তো পরিবারের আলোর প্রদীপ ছিলেন। ভবিষ্যতে পরিবারের দায়িত্ব নিতেন তারা। সুতরাং এসব পরিবারের ক্ষতিপূরণের জন্য আসামিদের সম্পদ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশপ্রেমিক বাহিনী রয়েছে সেনাবাহিনী। যাদের সব সময় ভালোবাসে দেশের জনগণ। তাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী বলা হয়। রাস্তায় দেখলে মানুষ তাদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। গত বছরের ৩ আগস্ট যখন পুলিশ নির্বিচারে মানুষ মারছে, সেনাবাহিনী তখন ছাত্র-জনতার মাঝখানে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বিচার শেষে চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকার ছিল। আশা করি, আমরা সেই অঙ্গীকার রক্ষা করতে পেরেছি। আমরা আদালতে একেবারে স্পষ্টভাবে তাদের অপরাধ প্রমাণ করেছি। এমন দৃঢ় প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, যা হিমালয়ের মতো দৃঢ় এবং হীরার চেয়েও স্বচ্ছ। এর মধ্য দিয়ে কেউ বলতে পারবে না, কারও প্রতি কোনো অবিচার করা হয়েছে।আন্তর্জাতিক আদালতসহ (আইসিসি) দুনিয়ার যে কোনো আদালতে এই সাক্ষ্যপ্রমাণকে যদি নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে প্রত্যেক আসামির সর্বোচ্চ দণ্ড নিশ্চিত হবে। এটা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে কাউকে ভুক্তভোগী করা বা প্রতিহিংসা নয়; ইতিহাসের একটা মীমাংসা এবং বাংলাদেশকে নিরাপদ করাসহ ভবিষ্যতের কোনোরূপ স্বৈরশাসকত্বের জন্য সতর্কবার্তা দিতে এই বিচার একটা চূড়ান্ত রায় হবে।
উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়ার অবশিষ্ট সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন : জুলাই আন্দোলনে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটজনের বিরুদ্ধে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার অবশিষ্ট সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষ্য দেন তিনি। জবানবন্দি শেষে প্রথমেই তাকে জেরা করেন শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেনের আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি। জেরার একপর্যায়ে আসিফকে তিনি বলেন, আপনাদের আন্দোলনে কোনো মাস্টারমাইন্ড ছিল কি না। জবাবে উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের ৫ জুন কোটাপ্রথা পুনর্বহালের রায়ের পর আমরা ৫৮ জন সমন্বয়ক-সহসমন্বয়ক মিলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন শুরু করি। এতে কোনো রাজনৈতিক দলের ইন্ধন ছিল না। আন্দোলনে প্রধানও কেউ ছিল না। সমন্বয়কদের সবার মর্যাদা সমান ছিল। যোগাযোগেরমাধ্যম কী ছিল? আইনজীবীর এমন প্রশ্নে আসিফ মাহমুদ বলেন, যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে আমরা ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেছি। কোনো মামলা হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করেন অভি। তখন এই উপদেষ্টা বলেন, আমিসহ আমাদের অনেকের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। একদফা কর্মসূচির পেছনে বিদেশি কোনো শক্তি বা কারও হাত ছিল কি না-আসামিপক্ষের আইনজীবীর এমন প্রশ্নে আসিফ বলেন, একদফা কর্মসূচি ঘোষণার পেছনে কোনো বিদেশি ইন্ধন ছিল না। আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়া আন্দোলনকারীরাই আন্দোলনের খরচের জন্য ফান্ড তৈরি করেছি।
সবাই দোয়া কইরো, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না-মামুন : এদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন হাজতখানা থেকে কারাগারে নেওয়ার পথে অন্য মামলায় গ্রেফতার পুলিশ সদস্যদের খোঁজ-খবর নেন। চানখাঁরপুলে ৬ আন্দোলনকারী হত্যা মামলার আসামি ৪ পুলিশ সদস্যকে সাবেক আইজিপি মামুন বলেন, ‘কেমন আছ তোমরা?’ পরে সবাই এক সুরে বলেন, ‘ভালো আছি স্যার।’ তখন তিনি বলেন, ‘সবাই দোয়া কইরো, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।’ এছাড়া দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে আশুলিয়ায় ৬ আন্দোলনকারীকে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেন সিআইডির ফরেনসিক শাখার আলোকচিত্র বিশেষজ্ঞ। পর্যাপ্ত সাক্ষী হাজির না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন ট্রাইব্যুনাল-২। চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।