সংবিধানের তফশিলে থাকবে জুলাই সনদ
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন:জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফশিল হিসাবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করবে। গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মঙ্গলবার রাতে সব রাজনৈতিক দলের কাছে চূড়ান্ত অনুলিপি পাঠানো হয়। এতে প্রথম ভাগে আছে সনদের পটভূমি। দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে সনদ বাস্তবায়নের ৭ দফা অঙ্গীকারনামা রয়েছে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। রাতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এসসিপিসহ ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি পাঠানো হয়; যা বিএনপিসহ অন্তত দশটি দল যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি নিয়ে দলগুলো নিজেদের ফোরামে আলোচনা করার কথা রয়েছে। শুক্রবার সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। কমিশন আশা করছে, এর মধ্যেই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ দেওয়া সম্ভব হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের (সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন) সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন।গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হয় জুলাই জাতীয় সনদ।শুক্রবার সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়। ইতোমধ্যে অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এই আয়োজনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে সহায়তা করছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রায় তিন হাজার অতিথিকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা আছে কমিশনের। সনদে সই করার জন্য ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আগেই কমিশন দলগুলোর কাছ থেকে দুজন করে স্বাক্ষরকারীর নাম চেয়েছিল। ইতোমধ্যে ৩৩টি দল ও জোট দুজন করে স্বাক্ষরকারীর নাম কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে। তবে সব দল শেষ পর্যন্ত সনদে সই করবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
কমিশন সূত্র জানায়, সনদের বিষয়ে আর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হবে না। এর আগে (গত ১১ সেপ্টেম্বর) যে খসড়া পাঠানো হয়েছিল, মূলত সেটি চূড়ান্ত আকারে পাঠানো হয়েছে। সেখানে মূল বিষয়বস্তুর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি, কিছু ভাষাগত সংশোধন করা হয়েছে।জুলাইয়ে জুলাই জাতীয় সনদ সই করার লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের। সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এতদিন সনদ আটকে ছিল। তবে কমিশন আগেই জানিয়েছিল, বাস্তবায়নের পদ্ধতি সনদের অংশ হবে না।গত ৩১ জুলাই সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরে ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলো ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে। ৯ অক্টোবর এই আলোচনা শেষ হয়। আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে মতভিন্নতা আছে।
৯ অক্টোবর দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় কমিশন জানিয়েছিল, বিশেষজ্ঞ ও দলগুলোর মতামত সমন্বয় করে কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারকে সুপারিশ করবে। এরপর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির সঙ্গে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে মতপার্থক্য কমাতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে কমিশন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গণভোটের ভিত্তি কী হবে, গণভোট কি সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে নাকি আগে, গণভোটে কী কী প্রশ্ন থাকবে-এসব বিষয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা এখনো কাটেনি। সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ আগামী শুক্রবারের মধ্যে চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে কি না, সেটা নিয়ে আলোচনা আছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ৭ দফা অঙ্গীকারনামা : অঙ্গীকারনামার শুরুতে আছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রকাশিত জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে নিম্নস্বাক্ষরকারীরা এই মর্মে অঙ্গীকার ও ঘোষণা করছি। সাত দফা হলো- জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসাবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসাবে জুলাই জাতীয় সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব। যেহেতু জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিক, তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সেহেতু রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসাবে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ গ্রহণ করেছি বিধায় এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফশিল হিসাবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করব। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করব না, উপরন্তু উক্ত সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করব। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করব। গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব এবং জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।