বাংলাদেশে ঋণের সুদের হার কোনো ক্রমেই ব্যবসাবান্ধব নয়…ব্যবসায়ীরা
মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন:আগামী মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে বা নয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার জোর দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, আগামী মুদ্রানীতিতে নীতি সুদের হার কমিয়ে এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনা হবে।বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল বৈঠক করে এ দাবি জানান। ওই বৈঠকেই গভর্নর আগামী মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় নীতি সুদের হার কমানোর আশ্বাস দেন।বাংলাদেশে ঋণের সুদের হার কোনো ক্রমেই ব্যবসাবান্ধব নয়। চড়া সুদের কারণে বিশ্ববাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে ঋণের সুদের হার অবশ্যই কমাতে হবে।বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তারা। ব্যবসায়ীদের পক্ষে শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনসহ (বিটিএমএ) চার সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়।
বৈঠকে বলা হয়, ঋণের সুদের হার লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমান ঋণের সুদের হার কোনো ক্রমেই ব্যবসাবান্ধব নয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখা, বিনিয়োগের স্বার্থে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে আনার দাবি করেন ব্যবসায়ীরা।তারা বলেছেন, ২০২২ সাল থেকে ঋণের সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী। আগে যেখানে ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদের হার ছিল, এখন তা বেড়ে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশে উঠেছে। তারপরও কোনো কোনো ব্যাংক ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিতে পারছে না। কোনো কোনো ব্যাংক রপ্তানি আয়ের টাকাও দিতে পারছে না। এসব সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তারা দাবি জানান।বৈঠকে ব্যবসায়ীদের দাবির জবাবে গভর্নর বলেন, ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছিল মূল্যস্ফীতির হার কমানোর জন্য। এখন এ হার অনেকটা কমে এসেছে। আগামীতে আরও কমবে। জানুয়ারিতে জানুয়ারি-জুন মেয়াদের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। তখন নীতি সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে নীতি সুদের হার ১০ শতাংশ। জানুয়ারিতে এ হার কমানো হলেও ঋণের সুদের হার তাৎক্ষণিকভাবে কমবে না। নীতি সুদের হার এক শতাংশ কমানো হলে বাজারে ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ কমতে পারে। এছাড়া আমানতের সুদের হার না কমলে ঋণের সুদের হার কমবে না। এখন ব্যাংকগুলোতে আমানত সংকট রয়েছে। যে কারণে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। ফলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে আমানতের সুদের হার কমানোও কঠিন হবে।
বৈঠকে রপ্তানিমুখী শিল্পের ব্যাংকিং সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ কমিটি গঠনের দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সময় সময় বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে যা তাৎক্ষণিক সমাধান জরুরি। এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে উচ্চপর্যায়ের একটি বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ কমিটিতে এফবিসিসিআই, বিজেএমইএসহ রপ্তানিসংক্রান্ত অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে গভর্নর একটি কমিটি করতে সম্মত হয়েছেন। একজন ডেপুটি গভর্নরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি অচিরেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে এ খাতে সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেবেন।
বৈঠকে ৫০ কোটি টাকার কম ঋণ পরিশোধ বা নবায়নের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা নীতি সহায়তা দাবি করেন। তারা বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপি হয়ে পড়েছেন। তাদের নীতি সহায়তা দেওয়া হলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। এ লক্ষ্যে পৃথক আরেকটি কমিটি গঠনের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গভর্নর বলেছেন, সমস্যা হবে না, ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো একসঙ্গেই সমাধান করা হবে।
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার সংক্রমণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষতিগ্রন্ত ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ও আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির মেয়াদ সেপ্টেম্বরে শেষ হয়ে গেছে। সেটা আরও ৬ মাস বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এতে গভর্নর সম্মত হয়েছেন বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে।
বৈঠক শেষে এফবিসিসিআই মহাসচিব মো. আলমগীর বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে সুদহার ১৪ শতাংশের ওপরে। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা মুনাফা করে ১০ থেকে ১১ শতাংশ। সুদের এই হার কোনো অবস্থাতেই ব্যবসাবান্ধব নয়। উচ্চ সুদের কারণে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন।
বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখা, বিনিয়োগের স্বার্থে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে আনার অনুরোধ জানিয়েছি। এ সময় গভর্নর জানিয়েছেন, নীতি সুদহার এক অঙ্কে নেমে আসবে। সেটা আগামী মুদ্রানীতিতেই।