‘মাথাব্যথা’ ভাসমান অপরাধীরা বাসা বদল করে ঘনঘন - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘মাথাব্যথা’ ভাসমান অপরাধীরা বাসা বদল করে ঘনঘন


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ‘মাথাব্যথা’র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফ্লোটিং ক্রিমিনাল বা ভাসমান অপরাধী।আবার ভাসমান অপরাধীদের একটি অংশ রাস্তাঘাটেও রাত্রিযাপন করে।তারা এক এলাকায় অপরাধ সংঘটিত করেই আত্মগোপনে যায় অন্য কোনো এলাকায়।এদের একটি বড় অংশ থাকে রাজধানীর উপকণ্ঠে। তারা দলবেঁধে রাজধানীতে এসে অপরাধ সংঘটিত করে ফের চলে যায়। এসব অপরাধীর শিকার ভুক্তভোগীরা মামলা করেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না।চুরি, ছিনতাই, খুন, মাদক বিক্রি, ধর্ষণ থেকে শুরু করে হেন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করে না। টাকার বিনিময়ে ভাড়ায়ও খাটছে এসব অপরাধী। অংশ নিচ্ছে টার্গেট কিলিংয়েও। এদের বেশির ভাগেরই বসবাসের কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই;আজ এক এলাকায় তো কাল অন্য এলাকায়। বাসা বদল করে ঘনঘন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভাসমান অপরাধীদের বেশির ভাগের নেই কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র। ফলে তাদের শনাক্ত করাও কঠিন। অপরাধ করে একবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের আড়ালে গেলে তাদের খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে ডিএমপির মাঠপর্যায়ে কর্মরতরা এ ভাসমান অপরাধীদের নিয়ে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন। তারা বলছেন, ভাসমান অপরাধীরা কোনো অপকর্ম করে অন্যত্র চলে যাওয়ার পর পুলিশের কাছে পরে খবর এলে তখন তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তদন্ত পর্যায়ে জটিলতা দেখা দেয়-এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা না হলে কেউ তাদের চিনতে পারে না। ফলে কোথা থেকে তারা এলো, কীভাবে কোথায় গেল, তা খুঁজে বের করা দুরূহ। এছাড়া ভাসমান অপরাধীদের ক্ষেত্রে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করাও খুবই জটিল হয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অপরাধ ও অপস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাসমান অপরাধীরা ল অ্যান্ড অর্ডারের (আইনশৃঙ্খলা) জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এরা দুদিন এখানে, দুদিন ওখানে থাকে। এদের নিয়ে নানারকম যন্ত্রণায় থাকতে হয়। এসব অপরাধীকে জাতীয় পরিচয়পত্রের আওতায়ও আনা যায় না।রাজধানীতে সক্রিয় থাকা ভাসমান অপরাধীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ভাসমান অপরাধীদের ব্যাপকতা উত্তরা এবং টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা এলাকায়। সেখানে শত শত ভাসমান অপরাধী রয়েছে। ভাসমান অপরাধী দমনে ভাড়াটিয়াদের তথ্য কালেকশন প্রোগ্রামে জোর দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর একটি আবাসিক হোটেলের কক্ষ থেকে ১৪ জুলাই ১২ বছর বয়সি এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার তদন্তে নেমে লোমহর্ষক তথ্য পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নিজের কাছে কোনো টাকা না থাকা ক্ষুধার্ত ওই শিশুটি ১২ জুলাই সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে ঘোরাফেরা করছিল। সেখান থেকে তাকে ডেকে নিয়ে খাবার ও কাপড় কিনে দিয়ে যাত্রাবাড়ীর আনোয়ারা আবাসিক হোটেলে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা করে আল-আমিন ও সাদ্দাম নামের দুই ব্যক্তি।মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর ঢাকা মেট্রোর (দক্ষিণ) উপপরিদর্শক কবির হোসেন জানান, আল-আমিন ও সাদ্দাম ভাসমান অপরাধী। তারা বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অবস্থান করে নানা অপরাধ সংঘটিত করে। আল-আমিন গ্রেফতার হলেও সাদ্দাম এখনো পলাতক।

জয়দেবপুর থেকে ১৪ জুলাই ট্রেনে রাজধানীর মতিঝিলের কমলাপুর স্টেশনে আসেন মিন্টু সরকার নামের এক স্বর্ণকার। সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জে নিজ বাসায় যাওয়ার সময় রাত সাড়ে ৩টার দিকে কমলাপুরের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের সামনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। তার কাছে থাকা মোবাইল ফোন ও ৮০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। পুলিশ জানায়, ছিনতাইকারীরা ভাসমান। তাদের মধ্যে তিনজনকে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়-রাজধানীতে প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন নানা অপরাধ। রাত নামলেই ভাসমান অপরাধীদের আনাগোনা বেড়ে যায়।

পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিটের করা প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, রাজধানীর চকবাজার থানা এলাকার ভাসমান অপরাধীদের মধ্যে পশ্চিম ইসলামবাগ চেয়ারম্যান ঘাট এলাকায় সক্রিয় রয়েছে মো. সাব্বির, কেল্লার মোড় এলাকায় সক্রিয় রয়েছে মো. আকাশ ও মো. মিরাজ। এছাড়া পশ্চিম ইসলামবাগ ঈদগাহ মাঠ এলাকায় মো. কালু ওরফে গ্রেনেড কালু, আরিফ হোসেন, মো. ইমন, মো. হান্নান। সায়েদাবাদ এলাকার মো. রনি, মো. রাসেল, মনির হোসেন, মো. তারেক ভাসমান চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত। হাতিরঝিল থানা এলাকায় ভাসমান অপরাধীদের মধ্যে রয়েছে-মোহাম্মদ আবু সাঈদ, মাসুম রতন, মো. রাকিব, মোহাম্মদ হোসেন ওরফে আকাশ।

সূত্র বলছে, পুলিশের বিশেষায়িত ওই ইউনিটের করা প্রতিবেদনে সাভার এলাকা থেকে রাজধানীতে এসে ছিনতাই, চুরিসহ নানা অপরাধে জড়ায় এমন ২৮ জনের নাম রয়েছে। এদের মধ্যে সাভারের হেমায়েতপুরের টুটুল, ব্যাংক কলোনির জাওয়াদ, অনিক ও স্বাধীন, গেণ্ডা এলাকার আমিরুল, মজিদপুরের শিপলু ও সাব্বির আহম্মেদ উষা, আক্কাস, সুমন, রেশমা, রাসেল, নাঈম, কামরুল হাসান, সজিব আহমেদ প্রমুখ। এদের অনেকের বিরুদ্ধে সাভার থানায় মামলাও রয়েছে।

সূত্র বলছে, রাজধানীর মতিঝিল এলাকার ভাসমান ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেশি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) খন্দকার ফজলে রাব্বি বলেন, ভাসমান এসব অপরাধী এক জায়গায় অপরাধ করে অন্য জায়গায় চলে গেলে সমস্যা। কিন্তু আমাদের এলাকায় নিয়মিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়-যাতে তারা অপরাধ সংঘটিত করতে না পারে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, রমনা এলাকায় বিভিন্ন সময় ছিনতাইয়ের যেসব ঘটনা ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেলে মোহাম্মদপুরের বছিলা থেকে এসে চাপাতি ব্যবহার করে ছিনতাই করে আবার চলে যায়। রমনা বিভাগের মধ্যে ভাসমান অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেশি শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও টিএসসি এলাকায়। অনেক দুষ্কৃতকারী ভাসমান অপরাধীদের অল্প কিছু টাকা দিয়ে ককটেল বানানোসহ নানা অপরাধমূলক কাজ করাচ্ছে।

রাজধানীর উত্তরা এলাকার ভাসমান অপরাধীদের একটি বড় অংশের বাস গাজীপুরের টঙ্গী ও ঢাকা জেলার আশুলিয়া এলাকায়। টঙ্গী থেকে আসা ভাসমান অপরাধীদের মধ্যে আছে আব্দুর রহমান, তৌহিদ, সবুজ মিয়া, সনজিত দাস, মানিক, আবুল কালাম, আরিফ, সাব্বির, মধু মিয়া প্রমুখ। আশুলিয়া থেকে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় আসা অপরাধীদের মধ্যে আছে আবুল হোসেন, জাকির, বাবুল হোসেন, সজিব, হাবিব ইসলাম, মো. ইউনুস শরীফ, শুভ মিয়া, জাহিদ, সোহাগ, সাকিল প্রমুখ।

রাজধানীর অপরাধপ্রবণ এলাকার মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুর থানা এলাকা। সেখানে সংঘটিত ভয়ংকর সব অপরাধের ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। এ এলাকার মূল সমস্যা ছিনতাই ও মাদক কারবার। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ভাসমান অপরাধীদের একটি বড় অংশ মোহাম্মদপুর এলাকায় বিচরণ করে। মিরপুর ১০ নম্বরের শহীদ মিল্লাদ ক্যাম্পে থাকে মো. রাজু। কিন্তু সে ছিনতাই করে মোহাম্মদপুর এলাকায়। একই ভাবে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় বাস করা মো. আলামিন চুরি-ছিনতাই করে বসিলা এলাকায়। হাজারীবাগের বাসিন্দা মো. রাব্বি ও মানিক ছিনতাই করে রায়েরবাজার শ্মশানঘাট ও বুদ্ধিজীবী কবরস্থান এলাকায়। রাজু সরদার কেরানীগঞ্জ মডেল থানা এলাকা থেকে এসে ছিনতাই করে রায়েরবাজার ও বুদ্ধিজীবী কবরস্থান এলাকায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রচুর ভাসমান অপরাধী রয়েছে। এ এলাকায় অপরাধ করে বিভিন্ন দিকে চলে যেতে পারে। অপরাধ করার সময় ধরা পড়লে সমস্যা হয় না। কিন্তু যখন অপরাধ করে অন্যত্র চলে যায় এবং আমাদের কাছে পরে খবর আসে তখন ডিটেক্ট করতে গেলে তাদের ট্রেস আউট করা (খুঁজে বের করা) ডিফিকাল্ট হয়ে পড়ে। কোথা থেকে এলো, কোথায় কিভাবে গেল-ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা না হলে কেউ চিনতেও পারে না তাদের।তিনি আরও বলেন, ভাসমান অপরাধীদের কারও বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হলে তাদের গ্রেফতার করা কঠিন। কারণ তারা আজ এই বাসায় আছে তো কাল অন্যখানে। এরপরও আমরা প্রতিনিয়ত অপরাধীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।

Top