গণভোট নিয়ে একমত হওয়ায় সংস্কারের ক্ষেত্রেও বড় অগ্রগতি হয়েছে
মোহাম্মাদ মহাব্বাতুল্লাহ মাহাদ:গণভোট নিয়ে একমত হওয়ায় সংস্কারের ক্ষেত্রেও বড় অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এমনকি এই অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেক উপদেষ্টা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। গণভোটে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হওয়ায় সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে ‘বড় বাধা’ কাটছে বলে মনে করছেন শীর্ষ রাজনীতিকসহ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যে অনিশ্চয়তার মেঘ জমেছিল, তা কেটে আশার আলো ফুটছে। ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’-এমন দাবিতে যারা অনড় ছিলেন, তারাও এ সিদ্ধান্তে খুশি।এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরবর্তী বৈঠক করবে এবং এর মধ্যে আইনি ও সংবিধানগত বিষয়গুলো নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে পরামর্শ করবে। কমিশন ১৫ অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে চায়।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, সংসদ নির্বাচনে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের আয়োজন-গুরুত্বপূর্ণ তিন ইস্যুতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বাহাস চলছে। বিষয়টি গড়িয়েছে রাজপথেও। জুলাই সনদ ও পিআর-মোটা দাগে দুটি বিষয়ে রাজপথে এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলছে। এমন প্রেক্ষাপটে রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে একমত হয় রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গণভোট কবে হবে, তা নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ রয়ে গেছে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট চায় বিএনপিসহ একটি পক্ষ। আর নির্বাচনের আগেই গণভোট চায় জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণভোট নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কাজটিই ছিল কঠিন। এটি যখন হয়ে গেছে, বাকি বিষয়গুলোও আটকে থাকবে না।
জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্যতম সদস্য এবং স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে সোমবার যুগান্তরকে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, এটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ ছিল। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এই মতবিরোধ কেটে গেছে। সব পক্ষ সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের পক্ষে মত দিয়েছে। সংস্কার বাস্তবায়ন প্রশ্নে এটি অবশ্যই একটি বড় অগ্রগতি। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে এতদিন যে ধোঁয়াশা, সংশয়-সন্দেহ তৈরি হয়েছিল, কিংবা সংকট ঘনীভূত হচ্ছিল, তাও এর মধ্য দিয়ে অনেকাংশে কেটে গেছে। বলা চলে-তরি এখন তীরের কাছাকাছি এসে গেছে। তিনি আরও বলেন, এখন গণভোট কীভাবে হবে, সে বিষয়ে একটি নির্দেশনা প্রয়োজন। আশা করি, সেটিও সমাধান হয়ে যাবে। একই দিনে গণভোট ও নির্বাচন, নাকি শুধু নির্বাচন এবং গণভোট আলাদা দিনে-আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়েও আলোচনার টেবিলে বসে ঐকমত্যে পৌঁছাবে। এ নিয়ে খুব একটা সমস্যা হবে না। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সোমবার বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে বিএনপি প্রথম থেকেই সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে গেছে। তিনি বলেন, কেউ কেউ জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের দাবি জানিয়েছে। গণভোটের বিধান যেহেতু সংবিধানে আগেও ছিল, শেখ হাসিনা এটা বাতিল করেছে। আমরা মনে করি, গণভোট হতে পারে। তাই আমরা এতে সমর্থন জানিয়েছি। যাতে সবার মনে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এ প্রসঙ্গে সোমবার বলেন, গণভোট প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে, এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তবে গণভোট কখন হবে, এ নিয়ে মতভিন্নতা আছে। আমরা জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে আগে গণভোটের প্রস্তাব করেছি। আশা করি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী বৈঠকে এ বিষয়টিরও ফয়সালা হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সরকার, ঐকমত্য কমিশন এবং রাজনৈতিক দলকে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এ প্রসঙ্গে সোমবার বলেন, গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানোর ফলে আগে যেখানে মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সংশয়-সন্দেহ এবং অনিশ্চয়তা ছিল, এখন তা কাটিয়ে ওঠা গেছে। ভোট নিয়ে অনিশ্চয়তার সেই মেঘ কেটে গেছে। দেশের সামনে এখন নির্বাচনের পথ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, একই দিনে গণভোট ও নির্বাচন হতে কোনো বাধা নেই।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক ও দলটির রাজনৈতিক লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান আরিফুল ইসলাম আদিবের সঙ্গে এ বিষয়ে মঙ্গলবার কথা হয়। তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে ঐকমত্য আমাদের একটা প্রাথমিক বিজয়। তবে এই গণভোট কখন এবং কী প্রক্রিয়ায় হবে-সে সম্পর্কে আমরা এখনো কিছুই জানি না। এছাড়া আমাদের মূল দাবি হচ্ছে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ। এজন্য নতুন সংবিধান ও এর অধীনে গণপরিষদ নির্বাচন। পাশাপাশি উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নিয়োগ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে একটি বিশেষ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ। এসব বিষয়ে সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।
রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নিশ্চিত করতে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। আমরা এটিকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রথম বড় ধাপ হিসাবে দেখছি। তিনি আরও জানান, তবে গণভোটের সময়সূচি নিয়ে এখনো মতভেদ আছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল চায় জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠিত হোক। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী চায় জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট হোক। যেন পরবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগেই সনদটি বাস্তবায়ন করা যায়। অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ সময় আরও বলেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর গঠিত সংসদ এমনভাবে সংস্কার আনার চেষ্টা করবে যেন তা দীর্ঘমেয়াদিভাবে কার্যকর ও টেকসই হয়। এ বিষয়েও কার্যত রাজনৈতিক দলগুলো একমত।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণভোট যদি নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠিত হয়, ভোটাররা আলাদা ব্যালট পেপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জানাবেন তারা সনদটির সমর্থন করেন কি না। এরপর যে দল পরবর্তী সংসদ গঠন করবে, তারা সনদ বাস্তবায়ন করবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, অন্যান্য বিষয় নিয়েও দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাবে। ড. বদিউল আলম মজুমদার আরও জানান, কমিশন শিগগিরই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে নির্দিষ্ট সুপারিশ পাঠাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে বেশকিছু প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। বাকিগুলো বিদ্যমান আইন বা সরকারি আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কীভাবে এগোতে হবে, রোববারের বৈঠকে অগ্রগতি অর্জনের আগে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। ১১, ১৪ ও ১৭ সেপ্টেম্বরের বৈঠকের পর রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য কিছু সময় দেওয়া হয়েছিল। এর আগে অচলাবস্থা কাটাতে সাংবিধানিক আদেশ জারি এবং সেই আদেশের ওপর সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবও দিয়েছিল কমিশন। তখন বিএনপি প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাবটিতে সমর্থন জানায়, তবে তারা গণভোট নির্বাচনের আগে আয়োজন করার প্রস্তাব দেয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি তখন বলেছিল তারা আইনি পরামর্শ নেবে।