জন্ম, জীবন-জীবিকা, মৃত্যু-সবকিছু নদীকে ঘিরেই,এক জলেভাসা জনগোষ্ঠীর নাম ‘মান্তা - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জন্ম, জীবন-জীবিকা, মৃত্যু-সবকিছু নদীকে ঘিরেই,এক জলেভাসা জনগোষ্ঠীর নাম ‘মান্তা


মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া:জন্ম, জীবন-জীবিকা, মৃত্যু-সবকিছু নদীকে ঘিরেই। এমন এক জলেভাসা জনগোষ্ঠীর নাম ‘মান্তা’।বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা বঞ্চিত এই জলযাযাবর সম্প্রদায়ের নৌকাই মূল ঠিকানা।মাছ ধরা তাদের একমাত্র পেশা। মুসলিম ধর্মাবলম্বী এই মানুষদের মৃত্যুর পর মাটিতে ঠাঁই হওয়ার নিজস্ব জায়গা নেই। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দুর্গম চরমোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস ঘাটের খালে প্রায় ৪০ বছর ধরে বাস করছে মান্তা সম্প্রদায়।

বেশির ভাগই সমাহিত হন অন্যের করুণায় পাওয়া জায়গায়। নদীর পাড়ে কিংবা কারও খোলা জমিতে। নদী তাদের বুকে স্থান দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্থলভাগ এখনো পুরোপুরি দেয়নি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তারা লড়ছে অভাবের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে, সমাজের অবহেলার সঙ্গে। তবু প্রতিদিন সকাল হলে নদীর জলে ভাসে তাদের নৌকা। আর সেই নৌকার সঙ্গে ভাসে এক টুকরো স্বপ্ন-একদিন তাদেরও হয়তো হবে নিজের ভিটা, নিজের মাটি, নিজের কবরস্থান। সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ দাবি বাবা-মায়েদের। তবে মান্তাদের অনেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ঘর এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন বলে জানান রাঙ্গাবালীর ইউএনও।

নৌকাই ঘর, নদীই ভরসা: ভোরের আলো ফোটার আগেই নদীর বুক চিরে ভেসে চলে ছোট ছোট নৌকা। ঢেউয়ের তালে দুলতে থাকা সেই নৌকাগুলোর একেকটি যেন একেকটি ভাসমান সংসার। জন্ম, মৃত্যু, হাসি-কান্না সবকিছুই এই জলের সঙ্গে মিশে আছে। প্রবীণদের ভাষ্যমতে, এক সময় তাদের পূর্বপুরুষদের জমি-জমা এবং ঘর-বাড়ি সবই ছিল। কিন্তু সর্বনাশা নদী ভাঙন তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। সেই থেকেই নদীর জীবন বেছে নিয়েছেন তারা। নদীই তাদের স্থায়ী ঠিকানা।

দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলের নদ-নদীতে এই জনগোষ্ঠীর বসবাস। রাঙ্গাবালীর চরমোন্তাজে ৪০ বছর ধরে বাস করছেন মান্তা জনগোষ্ঠী। বর্তমানে তাদের পরিবারের সংখ্যা দেড় শতাধিক। ১৯৮৫ সাল থেকে মান্তারা এখানে বসবাস শুরু করেন। তারা মাছ ধরে জীবন চালান। সরকারি উদ্যোগে বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর তীরে ৮৪ পরিবার ভূমিসহ ঘর পেলেও, এখনো বহু পরিবার নদীর বুকে নৌকায় দিন কাটান।

অভাব, হতাশার মাঝেও টিকে থাকা: প্রতিদিন ভোর হলেই নৌকা নিয়ে যেতে হয় নদীতে। পরিবারের কেউ নদীতে জাল পাতে। কেউ নৌকার এক কোণে জ্বালায় চুলা। এর ফাঁকেই দেখাশোনা করতে হয় শিশুদের। মাছ ধরতে না পারলে চুলায় আগুন জ্বলে না। নদীতে মাছ কমে গেলে ধারদেনা করে চাল আনেন। আর তা না হলে কখনো খালি পেটেই কাটে দিন-রাত।

মান্তা সম্প্রদায়ের ৬৫ বছর বয়সি বৃদ্ধা আমিরজান বিবি বলেন, ‘কখনো কখনো তিন-চার দিন মাছ পাই না। তখন চাল ধার করি, আবার মাছ পেলে পরিশোধ দিই। অভাব আমাদের ছায়ার মতো সঙ্গে থাকে।’ শুধু অভাবই নয়, ঝড়-বৃষ্টি আর দুর্যোগও প্রতিদিনের আতঙ্ক।

কবরস্থান চায় মান্তা জনগোষ্ঠী: মৃত্যুর পরও স্বস্তি নেই এই মানুষদের। নিজস্ব কবরস্থান নেই। অন্যের জমিতে কবর দিতে হয়। অন্যের করুণায় পাওয়া জায়গায়, নদীর পাড়ের খাস জমি কিংবা কারও খোলা জমিতেই হয় তাদের শেষ আশ্রয়। জীবনের শেষ পর্যন্ত নদীতে ভাসা মান্তা মানুষের একটাই প্রার্থনা-‘জীবনে ভেসে বেড়াই, মরলে যেন নিজের মাটিতে ঘুমাই।’

চরমোন্তাজ মান্তা পল্লীর ৯০ বছরের বৃদ্ধ রুস্তম আলী বলেন, ‘আমাগো কপালে নিজেগো ভিটা নাই। কবরের জায়গাও নাই। কেউ মরলে নদীর ধারে অন্যের জায়গায় কবর দেই। আমাদের জন্য আলাদা একটা কবরস্থান হলে মরেও শান্তি পাইতাম। মরলে নিজের মাটিতে কবর হতো।’

তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেরিয়ে এগিয়ে চলা: এক সময় এই মানুষদের দিকে ডাঙার মানুষ তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাত। তাদের সঙ্গে কেউ মিশত না। ৭০ বছর বয়সি কাঞ্চন আলী বলেন, ‘আগে আমরা ঘাটে গেলে মানুষ পাশ কাটিয়ে যেত। এখন সবাই কথা বলে, বিপদে-আপদে পাশে থাকে। কেউ কেউ শিশুদের স্কুলে পাঠানোর জন্য সাহায্যও করে।’

সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ চান বাবা-মায়েরা: শিক্ষার আলো থেকে বহুদূরে ছিল মান্তা জনগোষ্ঠী। কিন্তু এখনকার প্রজন্মের মান্তা বাবা-মায়েরা চান তাদের সন্তানরা যেন নৌকার সীমায় বন্দি না থেকে শিক্ষার আলোয় বেড়ে ওঠে। মান্তা পল্লীসংলগ্ন এলাকায় জাগো নারী নামক একটি বেসরকারি সংস্থা মান্তা শিশুদের জন্য ‘শিশু বাগান স্কুল’ নির্মাণ করে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে। সেখানে পড়ালেখা করছে ৫০ জন শিশু। তাদেরই একজন সুমি আক্তার (৭)। সে বলে, ‘আমি সকালে স্কুলে যাই। স্কুল শেষে বাবা-মায়ের সঙ্গে নদীতে মাছ ধরি।’ ওই স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব খান বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবুও আমি নিজ উদ্যোগে এই শিশুদের লেখাপড়া করিয়ে যাচ্ছি। ওদের মধ্যে শিক্ষার আগ্রহ তৈরি করার চেষ্টা করছি। কারণ, এই কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে ওরা আবার শিক্ষার আলোর বাইরে চলে যাবে। তাই নতুন করে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পাশাপাশি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ থাকলে শিশুদের জন্য উপকার হতো।’

রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজীব দাশ পুরকায়স্থ বলেন, মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজন এখন জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে, ভোটার হয়েছে। তাদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ঘর দেওয়া হয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছে তারা। তিনি আরও বলেন, তাদের কবরস্থানের বিষয়ে কী করা যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

Top