সব হারিয়ে কেউ এলাকা ছাড়ছেন, কেউ অন্যের জমি ইজারা নিয়ে সেখানে থাকছেন
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন:সব হারিয়ে কেউ এলাকা ছাড়ছেন, কেউ অন্যের জমি ইজারা নিয়ে সেখানে থাকছেন যাযাবরের মতো অস্থায়ী ঘর তুলে। ভাঙনের শিকার এসব নিঃস্ব মানুষের সহায়তায় সরকারি সহায়তা খুবই অপ্রতুল। নদীশাসন কিংবা ভাঙন রোধে নেই তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগ। কমছে পানি বাড়ছে নদীভাঙন। আর এই নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারাচ্ছে হাজারো মানুষ। চোখের সামনে নদী কেড়ে নিচ্ছে জমিজমা, বসতবাড়ি, স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ, বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জিও ব্যাগ (বালু ভর্তি ব্যাগ) ফেলানোর কর্মসূচি নেয়া হলেও সেখানে চলে ব্যাপক দুর্নীতি। সব মিলিয়ে নদীভাঙনের মতো এই ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য সরকারে পক্ষ থেকে আন্তরিক পদক্ষেপের অভাব বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা মনে করেন, নদীভাঙন রোধে সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব, ভুল নীতি ও পশ্চিমা পদ্ধতি অনুসরণ, আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতা রোধে সরকারের ব্যর্থতার কারণে ভাঙন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এছাড়াও, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন এবং একটি জাতীয় নদী-নীতি প্রণয়নে ঘাটতিও এর অন্যতম কারণ। বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, নদীভাঙন প্রতিরোধ ও নদী-ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে পর্যাপ্ত সমন্বয় নেই। শুধু কঠোর বাঁধ নির্মাণ বা পশ্চিমা পদ্ধতির ‘কর্ডন অ্যাপ্রোচ’ অনুসরণ করা হচ্ছে, যা কার্যকর না হয়ে বরং সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা, যেমন ডেল্টা প্ল্যান বিদেশি সংস্থার দ্বারা তৈরি হচ্ছে, যা স্থানীয় বাস্তবতার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নদী দখলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ এবং তদারকির অভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নদী দখল করে রাখছে, যা ভাঙন বাড়াচ্ছে। নদীভাঙন রোধে একটি জাতীয় নীতি প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।
এক্ষেত্রে নদীভাঙনের কারণগুলো চিহ্নিত করে একটি সমন্বিত ও টেকসই জাতীয় নদী-নীতি প্রণয়ন করতে হবে। প্রাকৃতিক উপায়, যেমনÑ গাছ লাগানো, নদীর তীরকে শক্তিশালী করতে পারে এবং ভাঙন রোধে সাহায্য করতে পারে। নদী দখল ও দূষণ বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। সারা দেশে নদীভাঙনের তথ্য নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন নিচে তুলে ধরা হলো :
শরীয়তপুর থেকে মেহেদী হাসান জানান, পদ্মা ও মেঘনার ভাঙনে দিশাহারা শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা ও গোসাইরহাটের আলাওলপুরের নদীপাড়ের মানুষ। গত ছয় মাসে সহস্রাধিক মানুষ গৃহহীন হয়েছে। পদ্মা নদীতে প্রবল স্রোতের কারণে ইতোমধ্যে জাজিরা উপজেলার নাওডোবায় পদ্মা সেতুর কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড রক্ষা বাঁধের পূর্ব দিক দিয়ে প্রায় অর্ধ-কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মা সেতু থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পূর্বে মাঝিরঘাটের অবস্থান। এই এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশে ভাঙন শুরু হয়েছে বর্ষার শুরু থেকেই। পদ্মার ডান তীর রক্ষা বাঁধের এ পযর্ন্ত প্রায় অর্ধ-কিলোমিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, রাস্তা, মসজিদ, ফসলি জমিসহ অর্ধশত স্থাপনা। ভাঙন আতঙ্কে পদ্মা পাড় থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বহু স্থাপনা। আতঙ্কিত হয়ে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন নদীপাড়ের মানুষ। আর ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ডাম্পিং করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
ভাঙনকবলিত এসব পরিবার অনেকে রাস্তাঘাট ও উঁচু জায়গায় অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছে। দ্রুত পুনর্বাসন ও ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। সরকারিভাবে ভাঙনকবলিতদের আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এছাড়া গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারিভাবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলেও তারা অভিযোগ করেছেন। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনই ভাঙনের অন্যতম প্রধান কারণ বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এছাড়াও নদীভাঙনের কারণ হিসেবে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ করেছেন অনেক ভুক্তভোগী পরিবার। শরীয়তপুরের জাজিরার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের মাঝিরঘাট এলাকার তাজুল মাদবর জানান, তার দুটি বসতঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীর পাড়ে হওয়ায় ভাঙন আতঙ্কে তাড়াহুড়ো করে সরিয়েছেন নিজের অন্য একটি ঘর ও ভাইদের বসতবাড়ি। তিনি বলেন, ‘চোখের সামনেই আমার দুটি বসতঘর নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। ভাঙন প্রতিরোধে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ধীরগতি পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কুড়িগ্রামের ১৬টি নদীর মধ্যে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার নদের ৩৩টি পয়েন্টে নদীভাঙন চলছে। ভাঙনে প্রতিদিন বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্বের তালিকায় শামিল হচ্ছেন শত শত নদীভাঙা মানুষ। ভাঙনে সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। সেই সাথে পরিবারের লোকজন ঠিকানা বদল করে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে। নদীভাঙা মানুষের কেউ খবর রাখে না। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, কুড়িগ্রাম জেলায় ৩৩টি পয়েন্টে প্রায় ৪৩১৫ কি.মি.জুড়ে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। চলমান ভাঙন ঠেকাতে কাজ শুরু করেছে পাউবো। ইমারজেন্সি ভাঙন প্রতিরোধে ২৫০ কেজি ওজনের বালুভর্তি জিও ব্যাগ ভাঙনকবলিত স্থানগুলোতে ফেলা হচ্ছে।
টাঙ্গাইল থেকে জানান, টাঙ্গাইলের যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীতে প্রতি বছর বর্ষা এলেই শুরু হয় ভাঙন। বর্ষার শুরুতে সদর উপজেলার যমুনা নদীর তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে কযেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ শতাধিক পরিবার। প্রতি বর্ষার দেড়-দুই মাস তারা ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটান। পানি বাড়তে থাকার চেয়ে কমার সময় ভাঙনের তীব্রতা বেশি থাকে। এ বছর প্রথম দফায় পানি বাড়লেও গত এক সপ্তাহে প্রায় আড়াই ফুট কমেছে। একই সাথে যমুনার ভাঙনও বেড়েছে। এ কারণে অনেকেই আগে থেকে যমুনা পাড়ের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে রাখছেন। কিন্তু যাদের অন্যত্র জায়গা-জমি নেই তারা সরাতে পারেননি। সম্প্রতি চরপৌলী এলাকায় জিও ব্যাগসহ কয়েকটি দোকান নদীগর্ভে চলে যায়। কাকুয়া ইউনিয়নে ঝাউগাছা থেকে ওমরপুর দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন আতঙ্কে অনেকেই বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী, দুর্গাপুর ও সল্লা ইউনিয়ন এবং ভূঞাপুরের গোবিন্দাসী, অর্জুনা ও গাবসারা ইউনিয়ন রয়েছে ঝুঁকির মুখে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, জিওব্যাগ ফেলার প্রায় ৩০০ মিটার দূর থেকে বাল্কহেডের মাধ্যমে বালু তোলার কারণে এসব জমি হুমকির মুখে রয়েছে। আব্বাস আলী নামে একজন বলেন, ‘এই পার বাঁধ দিতাছে উপার ভাঙবে এই বাঁধ দিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ ডেজার দিয়ে মাটি কাটলে সেই বাঁধ টিকবে না।
ভোলা থেকে জানান, নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ভোলা। ভোলার নদীর ভাঙন একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোলাবাসীর জন্য। এর মূল কারণ অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনকে দায়ী করছেন ভোলাবাসী। ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে নিজের ভিটেমাটি রক্ষা করার জন্য নদীতীরে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করতে প্রায়শই দেখা যায় নদীভাঙন কবলিত অসহায় ভোলার মানুষকে। এ ভাঙনের মূল কারণ ভোলা মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন এবং বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল স্রোতকে দায়ী করছেন অসহায় ভুক্তভোগীরা। ভাঙনের ফলে গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় শতাধিক পরিবার। ভেঙে গেছে একটি বাজার, মসজিদ, দুটি মক্তব, হিফজ মাদরাসাসহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভাঙনের তীব্রতা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, অনেক পরিবার তাদের ঘর সরিয়ে অন্যত্র নেয়ার সময়ও পাচ্ছে না। যারা ভাঙন থেকে বসতঘর রক্ষা করতে পারেননি, তারা বসবাড়ি হারিয়ে নদীপাড়ে বসে আর্তনাদ করছেন। চোখের পলকেই মেঘনা নদীতে বাড়িঘর ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে এই চরে বসবাসকারী দুই গ্রামের প্রায় আট হাজার মানুষের। তবে নদীভাঙন রোধে ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তীব্র ক্ষোভ আর শংকার সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।
গাইবান্ধা থেকে জানান, গাইবান্ধার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা, ব্রহ্মপুএ, যমুনা ও করোতোয়া নদীর তীরবর্তী এলাকা ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব ভাঙন এলাকায় প্রতিরক্ষামূলক কাজ গ্রহণ করলেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন না হওয়ায় এসব ভাঙনে তীব্রতা রয়েছে। এর মধ্যে ফুলছড়ি উপজেলার শিংরিয়া, উরিয়, এরেন্ডাবাড়ি ও সাঘাটা উপজেলার জুমাবিড়ি সদর উপজেলার কমারজানি মোল্লার চর এলাকায়। এদিকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের তিস্তা নদীর অব্যাহত ভাঙনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কয়েক শ’ পরিবার। কানি-চরিতাবাড়ি, লখিয়ারপাড়া, পাড়াসাদুয়া, চর-মাদারীপাড়া ও বোয়ালীর চরসহ বির্স্তীর্ণ এলাকায় ইতোমধ্যে তিন শতাধিক পরিবারের বসতভিটা, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট এবং বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া, আরো বহু পরিবার নতুন করে হুমকির মুখে রয়েছে। স্থানীয় ভুক্তভোগীদের দাবি, নদীভাঙন ও বন্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে, তিস্তা নদীর চরের কারণে পানির প্রবাহ তাদের বসতভিটার দিকে ধাবিত হয়ে ভাঙন ত্বরান্বিত করছে।
নীলফামারী থেকে জানান, উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদীবিধৌত এলাকা হচ্ছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা। দেশের সর্ববৃহৎ ও অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা সেচ প্রকল্প, যার মূল অংশ তিস্তা ব্যারাজ। এই উপজেলার সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বয়ে আসে তিস্তা নদীর পানি। এই নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে ফসলি জমি, বসতবাড়ি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্মিত বাঁধ। কিন্তু উত্তরবঙ্গের প্রাণখ্যাত তিস্তা নদী এখন এক ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় দিন-রাত চলছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। প্রভাবশালী চক্রের মদদে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যবহার করে নদী থেকে অবাধে তুলে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর। এর ফলে একদিকে যেমন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ভাঙনের কবলে পড়ে ভিটেমাটি হারাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিদিন উপজেলার বাইশপুকুর, চরখড়িবাড়ি, একতা বাজার, তেলির বাজার, তিস্তা বাজার, কালিগঞ্জ ও ছোটখাতা গ্রোয়েন বাঁধসহ অন্তত ১৫-২০টি স্থানে চলছে এই ধ্বংসাত্মক কাজ। তিস্তা নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর বালু উত্তোলনে প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জেল-জরিমানাসহ বিপুল পরিমাণ পাথর জব্দ করার পরেও নীলফামারীর ডিমলার তিস্তাপাড়ে থামানো যাচ্ছে না অবৈধ পাথর বালু উত্তোলনকারী চক্রকে।
মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, মুন্সীগঞ্জে পদ্মা নদী ভাঙনের মুখে পরেছে সদর উপজেলার বাংলা বাজার ইউনিয়নের শম্বুকান্দি এবং লৌহজং উপজেলার গাওদিয়া ইউনিয়নের হাঁড়িদিয়া টংগিবাড়ী উপজেলার দীঘিরপাড় বাজার। গত কয়েক দিনের ভাঙনে দোকানপাট, কৃষিজমিসহ ২০টি বসতঘর ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অর্থ ব্যয় কোনো কাজে আসছে না। পদ্মা নদীর ভাঙনের মুখে সদর উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের শম্বু হালদারকান্দি গ্রামের ২০টি বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভিটেমাটি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে কেউ অন্যের জায়গায় ঘর নির্মাণ করছে। ভাঙন রোধে গত বছর নদীতে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তীব্র ¯্রােতে নদীর তলদেশ থেকে সরে গেছে জিও ব্যাগ। নদীভাঙনে হুমকির মুখে রয়েছে তিনটি মসজিদসহ বেশ কিছু বাড়িঘর।
শেরপুর থেকে জানান, শেরপুরে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ের মানুষ! শেরপুরের নকলা উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছেন চর অষ্টধর ইউনিয়নের শতাধিক পরিবার। উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ঘেঁষা নারায়ণখোলা দক্ষিণ, রায় অষ্টধর ও ভেবুয়ারচর গ্রামে গত কয়েক বছরে বাড়িঘর ও ফসলি জমি হারিয়ে তারা আজ দিশাহারা হয়ে পড়েছে! অনেকেই আবার নদীর ওপারে জেগে ওঠা চরে বসতি গড়েছেন। তাও কখন ভেঙে যায় আল্লাহই ভালো জানেন। কেউবা কাজের সন্ধানে ছেড়েছেন এলাকা। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা না পেয়ে পরিবারগুলো ক্রমেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। হাছনা ভানু (৪৬) এক বিধবা নারী বর্তমানে কেজাইকাটা ঘাটে একটি ছোট্ট চা-পানের দোকান দিয়ে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তিনবারের ভাঙনে তাদের ৮০ শতাংশ জমিসহ বাসতভিটাও বিলীন হয়ে গেছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী স্বামী আজাহার আলী ও সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বোনের বাড়িতে।
ফরিদপুর থেকে জানান, ফরিদপুর জেলায় বিভিন্ন উপজেলায় আবারো শুরু হয়েছে নদীভাঙন। নদীভাঙনে, ফরিদপুর সদর, আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী, সদরপুর চরভদ্রাসন, ভাঙ্গা উপজেলার কমপক্ষে ২০-২৫ হাজার মানুষ বিপন্ন হওয়ার পথে। বিশেষ করে, ফরিদপুর সদর থানার ডিক্রিচড় ও ইউনিয়নের তিন চারটি ওয়ার্ড। নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের দুই-তিনটি ওয়ার্ড, সদরপুরের কমপক্ষে দুই হাজার বিঘা ফসলি জমি, চরভদ্রাসন উপজেলার একটি ইউনিয়ন বাদে সব ইউনিয়ন পদ্মার বুকে বিলীন হয়ে গেছে। অপরদিকে, মধুখালি উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ ডিগ্রি কলেজ এলাকার কমপক্ষে ২০০ বিঘা জমিসহ মধুমতী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এক বছর আগে। আলফাডাঙ্গা উপজেলার টিটা এলাকায় তথা সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের এলাকায়, ব্যাপক নদীভাঙনে কয়েক শ’ পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে।
মানিকগঞ্জ থেকে জানান, মানিকগঞ্জ জেলার পদ্মা, যমুনা, কালিগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর অব্যাহত ভাঙনে এ বছর নতুন করে সর্বস্বান্ত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার পরিবার। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বর্ষা মৌসুমেই প্রায় দুই হাজার ৬০০ পরিবার ভাঙনের শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। একই সঙ্গে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে দুই শতাধিক হেক্টর আবাদি জমি। সবচেয়ে বেশি হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে দৌলতপুর উপজেলার নিজ ভারাঙ্গা গ্রামে। গত ৭ জুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনটি সম্পূর্ণভাবে পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বিদ্যালয়টি ছিল শত শত শিক্ষার্থীর একমাত্র ভরসা। প্রতিষ্ঠানটি হারিয়ে শিক্ষাজীবন এখন মারাত্মক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এ ছাড়া নদীর ভাঙনে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের অংশ বিশেষও নদীতে বিলীন হয়ে যায়। পরে কর্তৃপক্ষ সেটি অন্যত্র স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়। নদী ভাঙনে প্রতি বছরই হাজারো পরিবার গৃহহারা হচ্ছে। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি কিংবা অস্থায়ী ঘরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।