রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক‘সচল হতে পারে আ.লীগের কার্যক্রম’ - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক‘সচল হতে পারে আ.লীগের কার্যক্রম’


জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক,আলোকিত বার্তা :অধিবেশনের ফাঁকে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিওর সাংবাদিক মেহদি হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের একটি অংশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ইস্যুতে এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা যে কোনো সময় তুলে নেওয়া হতে পারে।জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকারের কিছু মন্তব্য নিয়ে রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার এমন সাক্ষাৎকার গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এমন মন্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কেউ কেউ তীব্র ভাষায় সমালোচনাও করেন। মোদ্দা কথা, বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি।

রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া বক্তব্য জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগ গণহত্যাকারী এবং গণদুশমন। যারা গুম করেছে, মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে, মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে নিয়ে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে; তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচার ও ক্ষমা চাওয়া ছাড়া দলটির বিষয়ে কারও ব্যক্তিগতভাবে কিছু করার আছে বলে মনে করে না দলগুলো। এছাড়া নির্বাচনের আগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত হলে নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত বা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কোনো চিন্তভাবনা তাদের নেই। নিষেধাজ্ঞা যেটা আছে, সেটাই থাকবে।

অবশ্য সাক্ষাৎকারে ‘আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা যে কোনো সময় তুলে নেওয়া হতে পারে’-এমন কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেননি বলে জানিয়েছে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) পরিচালিত ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান বাংলাফ্যাক্ট। বাংলাফ্যাক্টের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আদতে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ‘কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারবে না’। এমনকি আগামী নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবে না। তার ভাষায়, ‘দলটির বৈশিষ্ট্য দেখে এবং তারা যে পুরো নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে, সেই সম্ভাবনা বুঝে নির্বাচন কমিশন ভেবেছে যে, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি না দেওয়াই ভালো।’ স্পষ্টতার খাতিরে তিনি আরও বলেন, ‘অন্যথায়, আমরা নির্বাচন করতে পারব না।’

তবে একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়টিকে তিনি ‘আপাতত’ বা ‘ফর দ্য টাইম বিয়িং’ বলতে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত’ কথাটা বুঝিয়েছেন। বাংলাফ্যাক্ট ইংরেজিতে সাক্ষাৎকারের ওই অংশটুকুও দিয়েছে। যার বাংলা অনুবাদ হুবহু তুলে ধরা হলো-

মেহদি হাসান : হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপনার সরকার তার সাবেক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে, তাদের নিবন্ধন স্থগিত করেছে, কার্যত পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে তাদের নিষিদ্ধ করেছে। আপনার মতোই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন, যিনি আপনাকে খুব ভালো করেই চেনেন, তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, এটা পূর্ববর্তী সরকারের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে, যারা ক্ষমতায় এসে তাদের বিরোধীদের নিষিদ্ধ করেছিল। আপনি কেবল সেই চক্রের পুনরাবৃত্তি করছেন। অমর্ত্য সেন ও অন্যদের এ ধরনের সমালোচনার কী জবাব দেবেন আপনি?

অধ্যাপক ইউনূস : এটা ভুল সমালোচনা। কারণ, আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি।

মেহদি হাসান : আমি বলছি, আপনি তো নিবন্ধন স্থগিত করেছেন?

অধ্যাপক ইউনূস : না, নিবন্ধন নয়। শুধু তাদের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।

মেহদি হাসান : এর অর্থ কী?

অধ্যাপক ইউনূস : এর অর্থ হলো, তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারবে না।

মেহদি হাসান : তাহলে আপনি মূলত, আমি বলছি, তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না।

অধ্যাপক ইউনূস : না, না। দলটি এখনো আছে।

মেহদি হাসান : তারা কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে?

অধ্যাপক ইউনূস : না, এখন পারবে না। তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ।

মেহদি হাসান : ঠিক আছে, তাহলে এটা কীভাবে…তারা কি দল হিসাবে বৈধ?

অধ্যাপক ইউনূস : আচ্ছা, তারা দল হিসাবে বৈধ, তবে এখন কার্যক্রম স্থগিত। যে কোনো সময় এর কার্যক্রম চালু করা হতে পারে।

মেহদি হাসান : আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি স্থগিতাদেশ তুলে নিতে পারেন?

অধ্যাপক ইউনূস : স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া, এটা একটা সম্ভাবনা।

মেহদি হাসান : তাহলে আপনি দলটিকে নিষিদ্ধ করেননি। আপনি শুধু বলেছেন, এখনকার জন্য তোমরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছ না।

অধ্যাপক ইউনূস : এটা ঠিক।

মেহদি হাসান : কিন্তু একটি গোষ্ঠীর মানুষকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ করাটা কতটা গণতান্ত্রিক?

অধ্যাপক ইউনূস : দেখুন, নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এটা করেছে দলটির চরিত্র ও সম্ভাবনা দেখে যে তারা পুরো নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই তারা ভেবেছে, এটা (আওয়ামী লীগের) না করাই ভালো…।

এদিকে এ বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসাবে শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত প্রত্যেকের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। অভিযুক্ত প্রত্যেকের বিচার করতে হবে। আওয়ামী লীগকে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত দলটির কার্যক্রম সচল হওয়া বা নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে মোটেও ভীত নয় গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিরা। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জনগণকে নিতে হবে। গণহত্যা, লুটপাট, নির্যাতন ও সব ধরনের অপকর্মের জন্য পতিত আওয়ামী লীগকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। এর আগে মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ীতে এক সমাবেশে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্য পুরো জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করলেও এ দেশের জনগণ ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগকে গণহত্যাকারী দল হিসাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীর কোথাও গণহত্যাকারী দল জনগণের সামনে দ্বিতীয়বার ফিরে আসতে পারেনি। আওয়ামী লীগও ফিরে আসতে পারবে না। যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করবে, জনগণ তাদের প্রতিহত করবে। জনগণের বুকে গুলি চালানো গণহত্যাকারী দল রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে।

জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ গত বছরে যা করেছে, যেভাবে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ মেরেছে। ফলে তাদের মানুষ দেখতে চায় না। এটা হলো পাবলিক সেন্টিমেন্ট। সেই চাপের মুখেই সরকার তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এখন কী কারণে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) এটা বললেন, তা বোধগম্য নয়। তবে যদি ওরকম কিছু সিদ্ধান্ত নির্বাচনের আগে হয়, তাহলে সার্বিকভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত, বাধাগ্রস্ত বা বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ মঙ্গলবার এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা প্রত্যাহার করুন। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো আপস নয়। আওয়ামী লীগের ব্যানার সন্ত্রাসী ব্যানার, এই ব্যানারে কোনো রাজনীতি চব্বিশের প্রজন্ম মেনে নেবে না। দেশকে আবার অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবেন না। অবিলম্বে আওয়ামী লীগকে দল হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করুন।’

একই বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আমি মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো একজন উপদেষ্টাকে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা নিজেও চাইলে দায়িত্ব নিতে পারেন। যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৪ মাসে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে তারা কাজ করেছেন, এখন পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিক। সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের নামে বিপ্লবী জনগণের চোখে ধুলা দিয়ে লাভ কী?’

এদিকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। বুধবার বরিশালে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘যখন একটি দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়, স্থায়ী নাকি অস্থায়ী, এ ধরনের প্রশ্ন থাকে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হবে-এমন কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। নির্বাচনের আগে তো দূরের কথা, অদূরভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের নিষেধাজ্ঞা উইথড্র হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কোনো কথাই বলেননি বলে জানিয়েছেন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এটি একটি ট্রান্সলেশনজনিত সমস্যা। আমার মনে হয়, পিআইবির বাংলাফ্যাক্ট এটার একটা যথাযথ উত্তর দিয়েছে। আমি আপনাদের বাংলাফ্যাক্ট দেখতে বলব। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য কিন্তু স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের যে নিষেধাজ্ঞা, সেটি উঠিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কোনো ধরনের কথা উনি বলেননি। নিষেধাজ্ঞা যেটা আছে, সেটাই থাকবে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে যে নিষেধাজ্ঞা, সেটি তুলে নেওয়ার কোনো চিন্তাভাবনা এই সরকারের নেই। সেই অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনও তাদের ওপর একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তারা নির্বাচন করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে এটি তো স্পষ্ট লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। কিন্তু অনেক সময় যারা অনুবাদ করেন, তারা আসলে একটা বাক্যের আগে দেখেন না। একটা কন্টেক্সে তো কথা বলা হয়, কিন্তু একটা বাক্যকে আউট অব কন্টেক্সে নিলে অনেক সময় এ ধরনের মেসেজ যায়। কিন্তু সে মেসেজটা ভুল মেসেজ।

Top